পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রিপূজা Գ Ե-S) বিদ্যাসাগর চরিত শ্রদ্ধাস্পদ শ্ৰীযুক্ত শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় বিদ্যাসাগরের জীবনী সম্বন্ধে যে প্রবন্ধ প্ৰকাশ করিয়াছেন তাহার আরম্ভে যোগবাশিষ্ঠ হইতে নিম্নলিখিত শ্লোকটি উদধূত করিয়া দিয়াছেন— তরবোহপি হি জীবন্তি জীবন্তি মৃগপক্ষিণঃ। স জীবতি মনো যস্য মননেন হি জীবতি । তরুলতাও জীবনধারণ করে, পশুপক্ষীও জীবনধারণ করে ; কিন্তু সেই প্রকৃতরূপে জীবিত যে মননের দ্বারা জীবিত থাকে। মনের জীবন মননক্রিয়া এবং সেই জীবনেই মনুষ্যত্ব। প্ৰাণ সমস্ত দেহকে ঐক্যদান করিয়া তাহার বিচিত্ৰ কাৰ্য-সকলকে একতন্ত্রে নিয়মিত করে। প্ৰাণ চলিয়া গেলে দেহ পঞ্চােত্বপ্রাপ্ত হয় ; তাহার ঐক্য ছিন্ন হইয়া মাটির অংশ মাটিতে, জলের অংশ জলে মিশিয়া যায়। নিয়তক্রিয়াশীল নিরলস প্ৰাণই এই শরীরটাকে মাটি হইতে, জল হইতে উচ্চ করিয়া, স্বতন্ত্র করিয়া, এক করিয়া স্বতশ্চালিত এক অপূর্ব ইন্দ্ৰজাল রচনা করে। মনের যে জীবন, শাস্ত্ৰে যাহাকে মনন বলিতেছে, তাহাও সেইরূপ মনকে এক করিয়া তাহাকে মনন-দ্বারা ঐক্যপ্ৰাপ্ত মন বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষিপ্ত হইয়া থাকে না, সে মন বাহ্যপ্রবাহের মুখে জড়পুঞ্জের মতো ভাসিয়া যায় না। কোনো মনস্বী ইংরাজ লেখক বলিয়াছেন— এমন লোকটি পাওয়া দুর্লভ যিনি নিজের পায়ের উপর খাড়া হইয়া দাড়াইতে পারেন, যিনি নিজের চিত্তবৃত্তিসম্বন্ধে সচেতন, কর্মস্রোতকে প্রবাহিত এবং প্রতিহত করিবার মতো বল যাহার আছে, যিনি ধাবমান জনতা হইতে আপনাকে উর্ধেব রাখিতে পারেন এবং সেই জনতাপ্রবাহ কোথা হইতে আসিতেছে ও কোথায় তাহার গতি তৎসম্বন্ধে যাহার একটি পরিষ্কৃত সংস্কার আছে । উক্ত লেখক যাহা বলিয়াছেন, তাহাকে সংক্ষেপে বলিতে হইলে বলা যায় যে, এমন লোক দুর্লভ ‘মনো যস্য মননেন হি জীবতি’ | সাধারণ লোকের মধ্যে মন-নামক যে একটা ব্যাপার আছে বলিয়া ভ্ৰম হয় তাহাকে খাড়া রাখিয়াছে কিসে ? কেবল প্ৰথা এবং অভ্যাসে । তাহার জড় অঙ্গগুলি অভ্যাসের আট দিয়া জোড়া, তাহা প্ৰাণের বন্ধনে এক হইয়া নাই । তাহার গতি চিরকাল-প্রবাহিত দশজনের গতি, তাহার অদ্যাতন দিন কল্যাতন দিনের অভ্যস্ত অন্ধ পুনরাবৃত্তিমাত্র । জলের মধ্যে তৃণ যেমন করিয়া ভাসিয়া যায়, মাছ তেমন করিয়া ভাসে না | তৃণের পথ এবং মাছের পথ সর্বদাই এক নহে। মাছকে খাদ্যের অনুসরণে আত্মরক্ষার উত্তেজনায় নিয়ত আপনার পথ আপনি খুজিয়া লইতে হয় ; তৃণ সে প্রয়োজন অনুভবই করে না। মননক্রিয়ার দ্বারা যে মন জীবিত তাহাকেও আত্মরক্ষার জন্যই নিজের পথ নিজে খুঁজিয়া বাহির করিতে হয়। দশজনের মধ্যে ভাসিয়া চলা তাহার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব । সাধারণ বাঙালির সহিত বিদ্যাসাগরের যে-একটি জাতিগত সুমহান প্ৰভেদ দেখিতে পাওয়া যায় সে প্রভেদ শাস্ত্রীমহাশয় যোগবশিষ্ঠের একটিমাত্র শ্লোকের দ্বারা পরিস্ফুট করিয়াছেন। আমাদের অপেক্ষা বিদ্যাসাগরের একটা জীবন অধিক ছিল। তিনি কেবল দ্বিজ ছিলেন না, তিনি দ্বিগুণজীবিত ছিলেন । সেইজন্য তাহার লক্ষ্য, তাহার আচরণ, তাহার কার্যপ্ৰণালী আমাদের মতো ছিল না। আমাদের সম্মুখে আছে আমাদের ব্যক্তিগত সুখদুঃখ, ব্যক্তিগত লাভক্ষতি ; তাহার সম্মুখেও অবশ্য সেগুলা ছিল, কিন্তু তাহার উপরেও ছিল তাহার অন্তজীবনের সুখদুঃখ, মনোজীবনের লাভক্ষতি। সেই সুখদুঃখ