পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

abrと রবীন্দ্র-রচনাবলী ততোধিক প্ৰবল ছিল। এমন একটি দৃষ্টান্ত দিলাম। কিন্তু তাহার জীবনের সকল কার্যেই দেখা গিয়াছে, তিনি যে চেতনারাজ্যে, যে মননলোকে বাস করিতেন, আমরা তাহা হইতে বহু দূরে অবস্থিত; তাহার চিন্তা ও চেষ্টা, বুদ্ধি ও বেদনা গতানুগতিকের মতো ছিল না, তাহা পারমার্থিক ছিল। পাষাণখণ্ডে বারংবার আহত-প্রতিহত হইয়াছিলেন বলিয়া, বিদ্যাসাগর তাহার কর্মসংকুল জীবন যেন চিরদিন ব্যথিত ক্ষুব্ধভাবে যাপন করিয়াছেন। তিনি যেন সৈন্যহীন বিদ্রোহীর মতো তাহার চতুর্দিককে গেছেন। তিনি কাহাকেও ডাকেন নাই, তিনি কাহারও সাড়াও পান নাই, অথচ বাধা ছিল পদে পদে । র্তাহার মননজীবী অন্তঃকরণ তাহাকে প্ৰবল আবেগে কাজ করাইয়াছিল, কিন্তু গীতজীবন বহিঃসংসার তাহাকে আশ্বাস দেয় নাই। তিনি যে শবসাধনায় প্রবৃত্ত ছিলেন তাহার উত্তরসাধকও ছিলেন তিনি নিজে । আধুনিক ইংলন্ডে বিদ্যাসাগরের ঠিক উপমা পাওয়া যায় না। কেবল জনসনের সহিত কতকগুলি বিষয়ে তাহার অত্যন্ত সাদৃশ্য দেখিতে পাই। সে সাদৃশ্য বাহিরের কাজে ততটা নয়—কারণ, কাজে বিদ্যাসাগর জনসন অপেক্ষা অনেক বড়ো ছিলেন, কিন্তু এই সাদৃশ্য অন্তরের সরল প্রবল এবং অকৃত্রিম মনুষ্যত্বে। জনসনও বিদ্যাসাগরের ন্যায় বাহিরে রূঢ় ও অন্তরে সুকোমল ছিলেন ; জনসনও পাণ্ডিত্যে অসামান্য, বাক্যালাপে সুরসিক, ক্ৰোধে উদ্দীপ্ত, মেহরসে আদ্ৰ, মতে নিভীক, হৃদয়ভাবে অকপট এবং পরহিতৈষায় আত্মবিস্মৃত ছিলেন। দুর্বিষহ দারিদ্র্যও মুহুর্তকালের জন্য তাহার আত্মসম্মান আচ্ছন্ন কিয়দংশ অনুবাদ করিয়া দিলাম “মতের পরিবর্তে কেবল কথামাত্র -দ্বারা তাহাকে ভুলাইবার জো ছিল না, এবং তিনি এমন কোনো মতবাদও গ্রাহ্য করিতেন না যাহা অকৃত্ৰিম আবেগ -উৎপাদনে অক্ষম। ইহা ব্যতীত, তাহার হৃদয়বৃত্তিসকল যেমন অকৃত্রিম তেমনি গভীর এবং সুকোমল ছিল। তাহার বৃদ্ধ এবং কুশ্রী স্ত্রীর প্রতি তাহার প্ৰেম কী পবিত্র ছিল! যেখানে কিছুমাত্র উপকারে লাগিত সেখানে তাহার করুণা কিরূপ সবেগে অগ্রসর হইত, “গ্রাব স্ট্রট’এর সর্বপ্রকার প্রলোভন হইতে তিনি কিরূপ পুরুষোচিত আত্মসম্মানের সহিত আপন সভ্রমরক্ষা করিয়াছিলেন, সে-সব কথার পুনরুল্লেখের প্রয়োজন নাই। কিন্তু বোধ করি, এ-সকল গুণের একান্ত দুর্লভতা সম্বন্ধে মনোযোগ আকর্ষণ করা ভালো। বোধ হয় অনেকেই আপনি পিতাকে ভালোবাসে- সৌভাগ্যক্রমে তাহা সত্য— কিন্তু কটা লোক আছে যাহার পিতৃভক্তি খোপামি-অপবাদের আশঙ্কা অতিক্রম করিতে পারে। কয়জন আছেন র্যাহারা বহুদিনগত এক অবাধ্যতা-অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত -সাধনের জন্য যুটকসিটারের হাটে পিতার মৃত্যুর বহুবৎসর পরেও যাত্ৰা করিতে পারেন। সমাজত্যক্তা রমণী পথপ্ৰান্তে নিরাশ্রয়ভাবে পড়িয়া আছে দেখিলে আমাদের অনেকেরই মনে ক্ষণিক দয়ার আবেশ হয়। আমরা হয়তো পুলিসকে ডাকি কিংবা ঠিকাগাড়িতে চড়াইয়া দিয়া তাহাকে সরকারি দরিদ্রাশ্রমে পাঠাই, অথবা বড়োজের সরকারি দরিদ্রপালনব্যবস্থার অসম্পূর্ণতার বিরুদ্ধে টাইমস পত্রে প্রবন্ধ লিখিয়া পাঠাই। কিন্তু এ প্রশ্ন বোধ করি জিজ্ঞাসা না করাই ভালো যে, কয়জন সাধু আছেন যাহারা তাহাকে কঁধে করিয়া নিজের বাড়িতে লইয়া যাইতে পারেন এবং তাহার জীবনে আমরা সাধুভাব ও সদাচার দেখিতে পাই; কিন্তু ভালো লোকের মধ্যেও এমন আদর্শ সচরাচর দেখিতে পাওয়া যায় না র্যাহার জীবন প্রচলিত লোকাচারের দ্বারা গঠিত নহে, অথবা র্যাহার হৃদয়বৃত্তি চিরাভ্যস্ত শিষ্টপ্রথার বাধা খাল উদবেল করিয়া উঠিতে পারে। জনসনের চরিত্রের প্রতি আমাদের যে প্রীতি জন্মে তাহার প্রধান কারণ, তাহার জীবন যে নেমি আশ্রয় করিয়া আবর্তিত হইত। তাহা মহত্ত্ব, তাহা প্ৰথামাত্রের দাসত্ব নহে। ...অ্যাডিসন দেখাইয়াছিলেন খ্রীস্টানের মরণ কিরূপ ; কিন্তু তাহার