পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্ৰপূজা ԳԵr S মইঃ মুর মধ্যে অনুভব করলে তবে আমাদের মাথা তুলিতে ইচ্ছা করে, মুক্তিকার আকর্ষণ হ্রাস হইয়া যায়। e মহাপুরুষেরা সমস্ত মানবজাতির গৌরবের ও আদর্শের স্থল বটেন, কিন্তু তাহারা জাতিবিশেষের বিশেষ গৌরবের স্থল তাহার। আর সন্দেহ নাই। গৌরবের স্থল বলিলে যে কেবলমাত্ৰ সামান্য অহংকারের স্থল বুঝায় তাহা নহে, গৌরবের স্থল বলিলে শিক্ষার স্থল, বললাভের স্থল বুঝায়। মহাপুরুষদিগের মহৎকাৰ্য-সকল দেখিয়া কেবলমাত্র সন্ত্ৰম মিশ্রিত বিস্ময়ের উদ্রেক হইলেই যথেষ্ট ফললাভ হয় না- তাহাদের যতই ‘আমার মনে করিয়া তাহাদের প্রতি যতই প্রেমের উদ্রেক হয়। ততই তাহাদের কথা, তাহাদের কার্য, তাহাদের চরিত্র আমাদের নিকট জীবন্ত হইয়া উঠে। যাহাদের লইয়া আমরা গৌরব করি তাহদের শুদ্ধমাত্র যে আমরা ভক্তি করি তাহা নহে, তাহাদের “আমার বলিয়া মনে করি। এইজন্য তাহাদের মহত্ত্বের আলোক বিশেষরূপে আমাদেরই উপরে আসিয়া পড়ে, বিশেষরূপে আমাদেরই মুখ উজ্জ্বল করে। শিশু যেমন সহস্ৰ বলবান ব্যক্তিকে ফেলিয়া বিপদের সময় পিতার কোলে আশ্রয় লইতে যায়, তেমনি আমরা দেশের দুৰ্গতির দিনে আর-সকলকে ফেলিয়া আমাদের স্বদেশীয় মহাপুরুষদিগের আটল আশ্রয় অবলম্বন করিবার জন্য ব্যাকুল হই। তখন আমাদের নিরাশ হৃদয়ে তাহারা যেমন বলবিধান করিতে পারেন এমন আর কেহই নহে। ইংলন্ডের দুৰ্গতি কল্পনা করিয়া কবি ওআর্ডসওআর্থ পৃথিবীর আর-সমস্ত মহাপুরুষকে ফেলিয়া কাতর স্বরে মিল্টনকেই ডাকিলেন ; কহিলেন, ‘মিল্টন, আহা, তুমি যদি আজি বাচিয়া থাকিতে ! তোমাকে ইংলন্ডের বড়োই আবশ্যক হইয়াছে।” যে জাতির মধ্যে স্বদেশীয় মহাপুরুষ জন্মান নাই সে জাতি কাহার মুখ চাহিবে— তাহার কী দুর্দশা! কিন্তু, যে জাতির মধ্যে মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু তথাপিও যে জাতি কল্পনার জড়তা— হৃদয়ের পক্ষাঘাত-বশত তাহার মহত্ত্ব কোনোমতে অনুভব করিতে পারে না, তাহার কী দুৰ্ভাগ্য! আমাদের কী দুৰ্ভাগ্য! আমরা প্ৰত্যেকেই নিজে নিজেকে মস্তলোক মনে করিয়া নিজের পায়ে পাদ্য-অর্ঘ্য দিতেছি, বাম্পের প্রভাবে স্ফীত হইয়া লঘু হৃদয়কে লঘুতর করিয়া তুলিতেছি। প্রতিদিনকার উপর বসাইয়া দুই দিনের মতো পুষ্পচন্দন দিয়া মহত্ত্বপূজার স্পাহা খেলাচ্ছলে চরিতার্থ করিতেছি, বিদেশীয়দের অনুকরণে কথায় কথায় সভা ডাকিয়া চাঁদা তুলিয়া মহত্ত্বপূজার একটা ভান ও আড়ম্বর করিতেছি। এজলাস হইতে জোনস সাহেব চলিয়া গেলে হাটে তাহার ছবি টাঙাইয়া রাখি, জেমস সাহেব আসিলে তাহার পায়ে পুস্পমাল্য দিই। অর্থের, বিনয়ের, উদারতার অভাব দেখিতে পাই না। কেবল আমাদের যথার্থ স্বদেশীয় মহাপুরুষকেই হৃদয় হইতে দূরে রাখিয়া, তাহাকে সম্মান করিবার ভার বিদেশীদের উপরে অপণ করিয়া নিশ্চিন্ত মনে বসিয়া রহিয়াছি ও প্ৰতিদিন তিন বেলা তিনটে করিয়া নূতন নূতন মৃৎপ্রতিমা-নির্মাণে নিরতিশয় ব্যস্ত হইয়া আছি। বর্তমান বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন রামমোহন রায় । আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, তাহার নিমিত ভবনে বাস করিতেছি। তিনি আমাদের জন্য যে কত প্ৰগাঢ় ভক্তি ও স্বজাতির প্রতি বিশ্বাস জন্মিবে। আমাদিগকে যদি কেহ বাঙালি বলিয়া অবহেলা করে আমরা বলিব, রামমোহন রায় বাঙালি ছিলেন। রামমোহন রায়ের চরিত্র আলোচনা করিবার আর-একটি গুরুতর আবশ্যকতা আছে। আমাদের এখনকার কালে তাহার মতো আদর্শের নিতান্ত প্ৰয়োজন হইয়াছে। আমরা কাতর স্বরে তাহাকে বলিতে পারি, “রামমোহন রায়, আহা, তুমি যদি আজ বাচিয়া থাকিতে ! তোমাকে বঙ্গদেশের বড়োই আবশ্যক হইয়াছে। আমরা বাকপটু লোক, আমাদিগকে তুমি কাজ করিতে শিখাও। আমরা আত্মম্ভরী, আমাদিগকে আত্মবিসর্জন দিতে শিখাও । আমরা লঘুপ্ৰকৃতি, বিপ্লবের স্রোতে চরিত্ৰগৌরবের প্রভাবে আমাদিগকে অটল থাকিতে শিখাও। আমরা বাহিরের প্রখর আলোকে অন্ধ, হৃদয়ের অভ্যন্তরস্থ