পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Տ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অরণ্যে ধ্যানধারণা করিয়া আমাদের ঋষিরা আমাদের ব্ৰহ্মকে পাইয়াছিলেন। আমরা তাহদের সেই আধ্যাত্মিক সম্পদের উত্তরাধিকারী। আর-কোনো জাতি ঠিক এমন সাধনা করে নাই, ঠিক এমন অবস্থায় পড়ে নাই, এইজন্য ব্ৰহ্মকে প্ৰাপ্ত হয় নাই। প্ৰত্যেক জাতি বিশেষ সাধনা। —অনুসারে বিশেষ ফল প্ৰাপ্ত হয়, সেই ফল তাহারা অন্য জাতিকে দান করে। এইরূপে সমস্ত পৃথিবীর উপকার হয়। আমাদের এত সাধনার ফল কি আমরা ইচ্ছাপূর্বক অবহেলা করিয়া ফেলিয়া দিব ? এইজন্যই বলি, ব্ৰাহ্মধর্ম পৃথিবীর ধর্ম বটে, পৃথিবীকে আমরা এ ধর্ম হইতে বঞ্চিত করিতে পারিও না চাহিও না, কিন্তু অবস্থা ও সাধনা। -বিশেষের গুণে ইহা বিশেষরূপে ভারতবর্ষেরই ব্ৰাহ্মধর্ম হইয়াছে, ব্ৰাহ্মধর্মের জন্য পৃথিবী ভারতবর্ষেরই নিকটে ঋণী। আমি যদি উদারতাপূর্বক বলি, খৃস্টধর্মে ব্ৰাহ্মধর্ম আছে, মুসলমান-ধর্মে ব্ৰাহ্মধর্ম আছে, তবে উদারতা-নামক পরম শ্রুতিমধুর শব্দটার গুণে তাহা কানে খুব ভালো শুনাইতে পারে, কিন্তু কথাটা মিথ্যা কথা হয়। সুতরাং সত্যের অনুরোধে মিথ্যা উদারতাকে ত্যাগ করিতে হয়। এইজন্য রামমোহন রায়ের ব্ৰাহ্মধর্ম ঋষিদেরই ব্ৰাহ্মধর্ম, সমস্ত জগতে ইহাকে প্রচার করিতে হইবে, এইজন্য সর্বাগ্রে ভারতবর্ষে ইহাকে বিশেষরূপে রোপণ করিতে হইবে। ভারতবর্ষের তো দারিদ্র্যের অভাব নাই, জীবন্ত ঈশ্বরকে হারাইয়া ভারতবর্ষ ক্ৰমাগত হীনতার অন্ধকূপে নিমগ্ন হইতেছে, আমাদের পৈতৃক সম্পদ যে ভাণ্ডারে প্রচ্ছন্ন আছে রামমোহন রায় সেই ভাণ্ডারের দ্বার উদঘাটন করিয়া দিলেন- আমরা কি গৌরবের সহিত মনের সাধে আমাদের দারিদ্র্যদুঃখ দূর করিতে পারিব! আমাদের দীনহীন জাতিকে এই একমাত্ৰ গৌরব হইতে কোন নিষ্ঠুর বঞ্চিত করিতে চাহে! আর-একটা কথা জিজ্ঞাসা করি— ব্ৰহ্মকে পাইয়া কি আমাদের হৃদয়ের পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি হয় না ? আমাদের ব্ৰহ্ম কি কেবলমাত্র নীরস দর্শনশাস্ত্রের ব্ৰহ্ম ? তাহা যদি হইত। তবে কি ঋষিরা তাহাদের সমস্ত জীবন এই ব্ৰহ্মতে নিমগ্ন করিয়া রাখিতে পারিতেন, তাহাদের সংসারের সমস্ত সুখদুঃখ এই ব্ৰহ্মে গিয়া নির্বাণ প্ৰাপ্ত হইত ? প্রেমের ঈশ্বর কি বিদেশী ধর্মে আছে, আমাদের ধর্মে নাই ? না, তাহা নয়। আমাদের ব্ৰহ্ম- রিসো বৈ সঃ । তিনি রসস্বরূপ । আমাদের ব্ৰহ্ম আনন্দস্বরূপ । কো হ্যেবান্যাৎ কঃ প্ৰাণ্যাৎ যাদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ । এষ হ্যেবানন্দয়াতি। এই আনন্দ সমস্ত আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া আছেন বলিয়াই আমাদের বাচিয়া আনন্দ। এইজন্য পুষ্পে আনন্দ, সমীরণে আনন্দ। এইজন্য পুত্রের মুখ দেখিয়া আনন্দ, বন্ধুর মিলনে আনন্দ, নরনারীর প্রেমে আনন্দ। এইজন্যই, আনন্দং ব্ৰহ্মণো বিদ্বান ন বিভেতি কদাচন। এই আনন্দকে পাইলে ভয় থাকে না, আনন্দের অবসান থাকে না। এত পাইয়াও কি হৃদয়ের আকাঙক্ষা অবশিষ্ট থাকে ? এমন অসীম আনন্দের আকর ঋষিরা আবিষ্কার করিয়াছেন ও আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন, তবে কিসের জন্য অন্যত্ৰ যাইব ? ঋষিদের উপার্জিত, ভারতবর্ষীয়দের উপাৰ্জিত, আমাদের উপার্জিত এই আনন্দ আমরা পৃথিবীময় বিতরণ করিব। এইজন্য রামমোহন রায় আমাদিগকে আমাদেরই ব্ৰাহ্মধর্ম দিয়া গিয়াছেন। আমাদের ব্ৰহ্ম যেমন নিকট হইতে নিকটতর, আত্মা হইতেও আত্মীয়াতর, এমন আর কোনো দেশের ঈশ্বর নহেন। রামমোহন রায় ঋষিপ্ৰদৰ্শিত পথে সেই আমাদের পরমাত্মীয়ের সন্ধান পাইয়াছেন, আমাদিগকেও সেই পথ দেখাইয়া দিয়াছেন। তিনি যদি স্পর্ধিত হইয়া নূতন পথ অবলম্বন করিতেন তবে আমাদিগকে কতদূরেই ভ্ৰমণ করিতে হইত— তবে আমাদের হৃদয়ের এমন অসীম পরিতৃপ্তি হইত না, তবে সমস্ত ভারতবাসী বিশ্বাস করিয়া তাহার সেই নূতন পথের দিকে চাহিয়াও দেখিত না। তিনি যে ক্ষুদ্র অভিমানে অথবা উদারতা প্রভৃতি দুই-একটা কথার প্রলোভনে পুরাতনকে পরিত্যাগ করেন নাই, এই তাহার প্রধান →श । বাস্তবিক, একটু ভাবিয়া দেখিলেই দেখা যায়, জ্ঞানের কথায় আর ভাবের কথায় একই নিয়ম খাটে না। জ্ঞানের কথাকে ভাষান্তরিত করিলে তাহার তেমন ক্ষতি হয় না, কিন্তু ভাবের কথাকে ভাষাবিশেষ হইতে উৎপাটিত করিয়া তাহাকে ভাষান্তরে রোপণ করিলে তাহার স্মৃর্তি থাকে না, তাহার ফুল হয় না, ফল হয় না, সে ক্রমে মরিয়া যায়। আমি ভারতবাসী যখন ঈশ্বরকে দয়াময় বলিয়া ডাকি তখন সেই ‘দয়াময়’ শব্দ সমস্ত অতীত ও বর্তমান ভারতবাসীর বিরাট হৃদয় হইতে প্ৰতিধ্বনিত হইয়া