পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চারিত্রপূজা Գ ՏԳ গময় - তখন তুমি বলিতেছ, “আমার ধন আছে, আমার মান আছে, আমার আরাম আছে, আমি প্ৰভু, আমি অধিপতি, আমার আর কী চাই!” ঐশ্বর্যের ইহাই বিড়ম্বনা- দীনাত্মার কাছে ঐশ্বৰ্যই চরম সার্থকতার রূপ ধারণ করে। অদ্যকার উৎসবে আমরা র্যাহার মাহাত্ম্য স্মরণ করিবার জন্য সমবেত । হইয়াছি, একদা প্রথম-যৌবনেই তাহার অধ্যাত্মদৃষ্টি এই কঠিন। ঐশ্বর্যের দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর অতিক্রম করিয়া তখনই ধনসম্পদের স্থূলতম আবরণ ভেদ করিয়া, স্তাবকগণের বন্দনাগানকে অধঃকৃত করিয়া, আরাম-আমোদ-আড়ম্বরের ঘন যবনিকা বিচ্ছিন্ন করিয়া, এই অমৃতবাণী তাহার কৰ্ণে কেমন করিয়া প্ৰবেশলাভ করিল যে ঈশাবাস্যমিদং সৰ্বং— যাহা-কিছু সমস্তকেই ঈশ্বরের দ্বারা আচ্ছন্ন দেখিবে, ধনের দ্বারা নহে, স্বার্থের দ্বারা নহে, আত্মাভিমানের দ্বারা নহে— যিনি ঈশানং ভূতভাব্যস্য, যিনি আমাদের অনন্তকালের ঈশ্বর, আমাদের ভূতভবিষ্যতের প্রভু, তাহাকে এই ধনিসন্তান কেমন করিয়া মুহুর্তের মধ্যে ঐশ্বর্যপ্ৰভাবের উর্ধের্ব, সমস্ত প্ৰভুত্বের উচ্চে আপনার একমাত্ৰ প্ৰভু বলিয়া প্ৰত্যক্ষ করিতে পারিলেন— সংসারের মধ্যে র্তাহার নিজের প্রভুত্ব, সমাজের মধ্যে র্তাহার ধনমর্যাদার সম্মান তাহাকে অন্ধ করিয়া রাখিতে পারিল না। আবার যেদিন এই প্রভূত ঐশ্বৰ্য অকস্মাৎ এক দুদিনের বজ্ৰাঘাতে বিপুল আয়োজন-আড়ম্বর লইয়া তাহার চতুর্দিকে সশব্দে ভাঙিয়া পড়িতে লাগিল— ঋণ যখন মুহুর্তের মধ্যেই বৃহদাকার ধারণ করিয়া তাহার গৃহদ্বার, তাহার সুখসমৃদ্ধি, তাহার অশািনবসন, সমস্তই গ্ৰাস করিবার উপক্রম করিল— তখনো পদ্ম যেমন আপন মৃণালবৃন্ত দীর্ঘতর করিয়া জলপ্লাবনের উর্ধের্ব আপনাকে সূৰ্যকিরণের দিকে নির্মল সৌন্দর্যে উন্মেষিত করিয়া রাখে, তেমনি করিয়া তিনি সমস্ত বিপদবন্যার উর্ধের্ব আপনার অস্নান হৃদয়কে ধ্রুবজ্যোতির দিকে উদঘাটিত করিয়া রাখিলেন। সম্পদ যাহাকে অমৃতলাভ হইতে তিরস্কৃত করিতে পারে নাই, বিপদও তাঁহাকে অমৃতসঞ্চয় হইতে বঞ্চিত করিতে পারিল না। সেই দুঃসময়কেই তিনি আত্মজ্যোতির দ্বারা সুসময় করিয়া তুলিয়াছিলেন ; যখন তাহার ধনসম্পদ ধূলিশায়ী তখনই তিনি র্তাহার দৈনের উর্ধের্ব দণ্ডায়মান হইয়া পরমাত্মসম্পদবিতরণের উপলক্ষে সমস্ত ভারতবর্ষকে মুহুর্মুহু আহবান করিতেছিলেন। সম্পদের দিনে তিনি ভুবনেশ্বরের দ্বারে বিশ্বাপতির প্রসাদ সুধাবণ্টনের ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন। ঐশ্বর্যের সুখশয্যা হইতে তুলিয়া লইয়া ধর্ম ইহাকে তাহার পথের মধ্যে দাড় করাইয়া দিল— ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া দুর্গং পথ্যস্ত।ৎ কবয়ো বদন্তি। কবিরা বলেন, সেই পথ নিশিত ক্ষুরধারার ন্যায় অতি দুৰ্গম পথ। লোকাচারপ্রচলিত চিরাভ্যস্ত ধর্ম আরামের ধর্ম, তাহা অন্ধভাবে জড়ভাবেও পালন করিয়া যাওয়া চলে এবং তাহা পালন করিয়া লোকের নিকট সহজেই যশোলাভ করিতে পারা যায়। ধর্মের সেই আরাম, সেই সম্মানকেও পিতৃদেব পরিহার করিয়াছিলেন। নিশিত ক্ষুরধারার ন্যায় দুরতিক্রম্য পথেই তিনি নিৰ্ভয়ে পদনিক্ষেপ করিলেন। লোকসমাজের আনুগত্য করিতে গিয়া তিনি আত্মবিদ্রোহী আত্মঘাতী হইলেন না। ধনিগৃহে র্যাহাদের জন্ম, পৈতৃক কাল হইতেই সমাজের নিকট সম্মানলাভে র্যাহারা অভ্যস্ত, সমাজপ্রচলিত সংস্কারের নিবিড় বৃহ ভেদ করিয়া নিজের অন্তৰ্লব্ধ সত্যের পতাকাকে শত্রুমিত্রের ধিককার লাঞ্ছনা ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অবিচলিত দৃঢ়মুষ্টিতে ধারণ করিয়া রাখা তাহাদের পক্ষে কোনোমতেই সহজ নহে— বিশেষত বৈষয়িক সংকটের সময় সকলের আনুকূল্য যখন অত্যাবশ্যক হইয়া উঠে তখন তাহা যে কিরূপ কঠিন সে কথা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। সেই তরুণ বয়সে, বৈষয়িক দুর্যোগের দিনে, সম্রাস্তসমাজে তাহার যে বংশগত প্ৰভূত প্রতিপত্তি ছিল তাহার প্রতি দৃকপাত না করিয়া, পিতৃদেব ভারতবর্ষের ঋষিবন্দিত চিরন্তন ব্রহ্মের— সেই অপ্রতিম দেবাদিদেবের আধ্যাত্মিক পূজা প্রতিকূল সমাজের নিকট মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করিলেন। তাহার পরে তাহার জীবনে আর-এক গুরুতর সংগ্রামের দিন উপস্থিত হইল। সকলেই জানেন,