পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চরিত্ৰপূজা bーの> ত্যাগাস্বীকার আমরা মনের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধিই বা করিব কী করিয়া, এবং তদনুরূপ কৃতজ্ঞতাই বা কেমন করিয়া অনুভব করিব ! আমাদের আদ্যকার সমস্ত অন্ন-বস্ত্ৰ-আশ্রয়ের পশ্চাতে র্তাহার সেই বপুৰুত্ব কম্পিত বলিষ্ঠ দক্ষিণহস্ত ও সেই হস্তের মঙ্গল আশিসম্পর্শ আমরা যেন নিয়ত নম্নভাবে অনুভব কার্য। আমাদের সর্বপ্রকার অভাবমোচনের পক্ষে প্রচুর এই-যে সম্পত্তি তিনি সম্পূর্ণ নিজের বলে রক্ষা করিয়াছেন, ইহা যদি অধর্মের সহায়তায় ঘটিত, তবে অদ্য অন্তর্যামীর সম্মুখে সেই পিতার নিকটে ধনরক্ষা করিয়াছেন— আদ্য আমরা যাহা লাভ করিয়াছি, তাহার সহিত তিনি অসত্যের গ্রানি মিশ্রিত করিয়া দেন নাই ; আজ আমরা যাহা ভোগ করিতেছি, তাহাকে দেবতার প্রসাদস্বরূপ নির্মলচিত্তে নিঃসংকোচে গ্ৰহণ করিবার অধিকারী হইয়াছি। সেই বিপদের দিনে তাহার বিষয়ী বন্ধুর অভাব ছিল না ; তিনি ইচ্ছা করিলে হয়তো কৌশলপূর্বক তাহার পূর্বসম্পত্তির বহুতর অংশ এমন করিয়া উদ্ধার করিতে পারিতেন যে, ধনগৌরবে বঙ্গীয় ধনীদের ঈর্ষাভাজন হইয়া থাকিতেন। তাহা করেন নাই বলিয়া আজ যেন আমরা তাহার নিকটে দ্বিগুণতর কৃতজ্ঞ হইতে পারি। ঘোর সংকটের সময় একদিন তাহার সম্মুখে একই কালে শ্রেয়ের পথ ও প্রেয়ের পথ উদঘাটিত হইয়াছিল। তখন সর্বস্ব হারাইবার সম্ভাবনা তাহার সম্মুখে ছিল— তাহার স্ত্রীপুত্র ছিল, তাহার মানসম্রাম ছিল- তৎসত্ত্বেও যেদিন তিনি শ্রোয়ের পথ নির্বাচন করিয়া লইলেন। সেই মহাদিনের কথা আজ যেন আমরা একবার স্মরণ করিবার চেষ্টা করি, তাহা হইলে আমাদের বিষয়লালসার তীব্ৰতা শান্ত হইয়া আসিবে এবং সন্তোষের অমৃতে আমাদের হৃদয় অভিষিক্ত হইবে। অর্জনের দ্বারা তিনি যাহা আমাদিগকে দিয়াছেন তাহা আমরা গ্ৰহণ করিয়াছি ; বর্জনের দ্বারা তিনি যাহা আমাদিগকে দিয়াছেন তাহাও যেন গৌরবের সহিত গ্ৰহণ করিবার যোগ্য আমরা হইতে পারি। তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থ ছিলেন। কিন্তু তিনি যদি শুদ্ধমাত্ৰ বিষয়ী হইতেন, তবে তাহার উদ্ধারপ্রাপ্ত সম্পত্তিখণ্ডকে উত্তরোত্তর সঞ্চায়ের দ্বারা বহুল রূপে বিস্তৃত করিতে পারিতেন। কিন্তু বিষয়বিস্তারের প্ৰতি লক্ষ রাখিয়া ঈশ্বরের সেবাকে তিনি বঞ্চিত করেন নাই। তাহার ভাণ্ডার ধর্মপ্রচারের জন্য মুক্ত ছিল— কত অনাথ পরিবারের তিনি আশ্রয় ছিলেন, কত দরিদ্র গুণীকে তিনি অভাবের পোষণ হইতে উদ্ধার করিয়াছেন, দেশের কত হিতকর্মে তিনি বিনা আড়ম্বরে গোপনে সাহায্য দিয়াছেন। এই দিকে কৃপণতা করিয়া তিনি কোনোদিন তাহার সন্তানদিগকে বিলাসভোগ বা ধনাভিমানচর্চায় প্রশ্রয় দেন নাই। ধর্মপরায়ণ গৃহস্থ যেমন সমস্ত অতিথিবীগের আহার-শেষে নিজে ভোজন করেন, তিনি সেইরূপ করিয়াছেন। এইরূপে তিনি আমাদিগকে ধনসম্পদের মধ্যে রাখিয়াও আড়ম্বর ও ভোগােন্মত্ততার হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছেন, এবং এইরূপে যদি তাহার সন্তানগণের সম্মুখ হইতে লক্ষ্মীর স্বর্ণপিঞ্জরের কিছুমাত্র অধিকারী হইয়া থাকেন, তবে নিশ্চয়ই তাহারা পিতার পুণ্যপ্ৰসাদে বহুতর লক্ষপতির অপেক্ষা সৌভাগ্যবান হইয়াছেন । আজ এই কথা বলিয়া আমরা সকলের কাছে গৌরব করিতে পারি যে, এতকাল আমাদের পিতা যেমন আমাদিগকে দারিদ্র্য হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন তেমনি ধনের গণ্ডির মধ্যেও আমাদিগকে বদ্ধ করিয়া রাখেন নাই। পৃথিবী আমাদের সম্মুখে মুক্ত ছিল— ধনী দরিদ্র সকলেরই গৃহে আমাদের যাতায়াতের পথ সমান প্ৰশস্ত ছিল। সমাজে র্যাহাদের অবস্থা আমাদের অপেক্ষা হীন ছিল তাহারা সুহৃদভাবেই আমাদের পরিবারে অভ্যর্থনা প্রাপ্ত হইয়াছেন, পারিষদভাবে নহে। ভবিষ্যতে আমরা ভ্ৰষ্ট হইতে পারি, কিন্তু আমরা ভ্ৰাতৃগণ দারিদ্র্যের অসম্মানকে এই পরিবারের ধর্ম বলিয়া জানিতে পাই নাই। ধনের সংকীর্ণতা ভেদ করিয়া মনুষ্যসাধারণের অকুষ্ঠিত সংস্রবলােভ র্যাহার প্রসাদে আমাদের Ν. Ο δ