পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brひS রবীন্দ্র-রচনাবলী ঘটিয়াছে তাহাকে আজ আমরা নমস্কার করি। তিনি আমাদিগকে যে কী পরিমাণে স্বাধীনতা দিয়াছেন তাহা আমরা ছাড়া আর কে জানিবে! যে ধর্মকে তিনি ব্যাকুল সন্ধানের দ্বারা পাইয়াছেন, যে ধর্মকে তিনি উৎকট বিপদের মধ্যেও রক্ষা করিয়াছেন, যে ধর্মের উদ্দেশে তিনি তাহার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন, সেই ধর্মকে তিনি আপনার গৃহের মধ্যেও শাসনের বস্তু করেন নাই। র্তাহার দৃষ্টান্ত আমাদের সম্মুখে ছিল, তাহার উপদেশ হইতে আমরা বঞ্চিত হই নাই, কিন্তু কোনো নিয়মের শাসনে তিনি আমাদের বুদ্ধিকে, আমাদের কর্মকে বদ্ধ করেন নাই। তিনি কোনো বিশেষ মতকে অভ্যাস বা অনুশাসনের দ্বারা আমাদের উপরে স্থাপন করিতে চান নাই- ঈশ্বরকে ধর্মকে স্বাধীনভাবে সন্ধান করিবার পথ তিনি আমাদের সম্মুখে মুক্ত করিয়া দিয়াছেন। এই স্বাধীনতার দ্বারা তিনি আমাদিগকে পরমসম্মানিত করিয়াছেন— তাহার প্রদত্ত সেই সম্মানের যোগ্য হইয়া সত্য হইতে যেন স্বলিত না হই, ধর্ম হইতে যেন স্বলিত না হই, কুশল হইতে যেন স্মৃলিত না হই। পৃথিবীতে কোনো পরিবার কখনোই চিরদিন একভাবে থাকিতে পারে না, ধন ও খ্যাতিকে কোনো বংশ চিরদিন আপনার মধ্যে বদ্ধ করিয়া রাখিতে পারে না, ইন্দ্ৰধনুর বিচিত্র বর্ণচ্ছটার ন্যায় এই গৃহের সমৃদ্ধি নিশ্চয়ই একদিন দিগন্তরালে বিলীন হইয়া যাইবে, ক্ৰমে নানা ছিদ্ৰযোগে বিচ্ছেদবিশ্লেষের বীজ প্ৰবেশ করিয়া কোনো একদিন এই পরিবারের ভিত্তিকে শতধা বিদীর্ণ করিয়া দিবে- কিন্তু এই পরিবারের মধ্য দিয়া যিনি অচেতন সমাজকে ধমজিজ্ঞাসায় সজীব করিয়া দিয়াছেন, যিনি নূতন ইংরাজিশিক্ষার ঔদ্ধত্যের দিনে শিশু বঙ্গভাষাকে বহু যত্নে কৈশোরে উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছেন, যিনি দেশকে তাহার প্রাচীন ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার উদঘাটিত করিতে প্ৰবৃত্ত করিয়াছেন, যিনি তাহার তপঃপরায়ণ একলক্ষ্য জীবনের দ্বারা আধুনিক বিষয়লুব্ধ সমাজে ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থের আদর্শ পুনঃস্থাপিত করিয়া গিয়াছেন, তিনি এই পরিবারকে সমস্ত মনুষ্যপরিবারের সহিত সংযুক্ত করিয়া দিয়া, করিয়া দিয়া, আমাদিগকে যে গৌরব দান করিয়াছেন, অন্য সমস্ত ক্ষুদ্র মানমর্যাদা বিস্মৃত হইয়া অদ্য আমরা তাহাই স্মরণ করিব ও একান্ত ভক্তির সহিত তাহার নিকটে আপনাকে প্ৰণত করিয়া দিব ও র্যাহার মধ্যে তিনি আশ্রয়লাভ করিয়াছেন সমস্ত ধনমানের উর্ধেব খ্যাতিপ্ৰতিপত্তির উর্ধেব তাহাকেই দর্শন করিব | ’ হে বিশ্ববিধাতঃ, আজ আমাদের সমস্ত বিষাদ-অবসাদ দূর করিয়া দাও- মৃত্যু সহসা যে যবনিকা অপসারণ করিয়াছে তাহার মধ্য দিয়া তোমার অমৃতলোকের আভাস আমাদিগকে দেখিতে দাও। সংসারের নিয়ত উত্থানপতন, ধনমানজীবনের আবির্ভাব-তিরোভাবের মধ্যে তোমার আনন্দরূপমমৃতং। প্ৰকাশ করো। কত বৃহৎ সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ হইতেছে, কত প্রবল প্ৰতাপ অস্তমিত হইতেছে, কত লোকবিশ্রুত খ্যাতি বিস্মৃতিমগ্ন হইতেছে, কত কুবেরের ভাণ্ডার ভগ্নস্তুপের বিভীষিকা রাখিয়া অন্তহিঁত হইতেছে- কিন্তু হে আনন্দময়, এই সমস্ত পরিবর্তনপরম্পরার মধ্যে ‘মধু বাতা ঋতীয়তে, বায়ু মধুবহন করিতেছে, ‘মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ, সমুদ্র-সকল মধুক্ষরণ করিতেছে- তোমার অনন্ত মাধুর্যের কোনো ক্ষয় নাই- তোমার সেই বিশ্বব্যাপিনী মাধুরী সমস্ত শোকতাপবিক্ষোভের কুহেলিকা ভেদ করিয়া অদ্য আমাদের চিত্তকে অধিকার করুক । মাধবীনঃ সন্তোষধীঃ, মধু নক্তম উতোষ সঃ, মধুমৎ পার্থিবং রজঃ, মধু দৌরস্তু নঃ পিতা, মধুমান্নো বনস্পতিঃ, মধুমান অস্তু সূৰ্যঃ, মাধবীগাবো ভবন্তু নঃ। ওষধিরা আমাদের পক্ষে মাধবী হউক, রাত্রি এবং উষা আমাদের পক্ষে মধু হউক, পৃথিবীর ধূলি আমাদের পক্ষে মধুমান হউক, এই-যে আকাশ পিতার ন্যায় সমস্ত জগৎকে ধারণ করিয়া আছে ইহা আমাদের পক্ষে মধু হউক, বনস্পতি আমাদের পক্ষে মধুমান হউক, সূর্য মধুমান হউক এবং গাভীরা আমাদের জন্য মাধবী হউক। S SDSS