পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সেজন্য র্তাহাকে যত দুঃখ, যত তিরস্কার হউক, সমস্ত স্বীকার করিতে হইয়াছিল- ইহা বঁাচাইবার জো নাই। ঈশ্বর যে তাহাই চান। তিনি বিশ্বের ঈশ্বর হইয়াও আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে একটি নিতান্ত একমাত্র স্বতন্ত্র সম্বন্ধে ধরা দিবেন— সেইজন্য আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে তিনি একটি দুৰ্ভেদ্য স্বাতন্ত্র্যকে চারি দিকের আক্রমণ হইতে নিয়ত রক্ষা করিয়াছেন- এই অতি নির্মল নির্জন নিভৃত স্বাতন্ত্র্যের মধ্যেই তাহার সঙ্গে আমাদের মিলনের স্থান নির্দিষ্ট রহিয়াছে। সেইখানকার দ্বার যখন আমরা বিশ্বের মধ্যে যাহা আমি ছাড়া আর কাহারও নহে সেইটেই যখন তাহার কাছে সমৰ্পণ করিতে পারিব, তখনই আর আমার কিছু বাকি থাকিবে না, তখনই তাঁহাকে পাওয়া যাইবে। এই-যে আমাদের স্বাতন্ত্র্যের দ্বার, ইহার প্রত্যেকের চাবি স্বতন্ত্র। একজনের চাবি দিয়া আর-একজনের দ্বার খুলিবে না। পৃথিবীতে র্যাহারা ঈশ্বরকে না পাওয়া পর্যন্ত থামেন নাই, তাহারা সকলেই ব্যাকুলতার নির্দেশ মানিয়া, নিজের চাবি নিজে যেমন করিয়া পারেন সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন। কেবল পরের প্রতি নির্ভর করিয়া আলস্যবশত এ র্যাহারা না করিয়াছেন তাহারা কোনো-একটা ধর্মমত ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মসম্প্রদায়ে পৌছেন নাই। আমাদের শক্তি যদি ক্ষীণ হয়, আমাদের আকাঙক্ষণ যদি সত্য না হয়, তবে আমরা শেষ পর্যন্ত কবে গিয়া পৌছিব জানি না। কিন্তু মহাপুরুষদের জীবন যেদিন আলোচনা করিতে বসিব সেদিন যেন সেই লক্ষ্যের কথাটাই সম্মুখে রাখি, তাহাদের স্মৃতি যেন আমাদিগকে পারের ঘাটের আলো দেখায়, তাহাকে যেন আমরা কোনোদিন সাম্প্রদায়িক অভিযানের মশাল করিয়া না তুলি। তাহাদের দৃষ্টান্ত নিজের সত্যশক্তিতে সত্যচেষ্টায় সত্যপথে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিবে, আমাদিগকে ভিক্ষা দিবে না, সন্ধান দিবে- আশ্রয় দিবে না, অভয় দিবে- অনুসরণ করিতে বলিবে না, অগ্রসর হইতে উৎসাহিত করিবে। এক কথায়, মহাপুরুষ তাহার নিজের রচনার দিকে আমাদিগকে টানিতেছেন না, ঈশ্বরের দিকে আহবান করিতেছেন। আজ আমরা যেন মনকে স্তব্ধ করি, শান্ত করি ; যাহা প্ৰতিদিন ভাঙিতেছে গড়িতেছে, যাহা লইয়া তর্কবিতৰ্ক-বিরোধবিদ্বেষের অন্ত নাই, যেখানে মানুষের বুদ্ধির রুচির অভ্যাসের অনৈক্য, সে-সমস্তকেই মৃত্যুর সম্মুখে যেন আজ ক্ষুদ্র করিয়া দেখিতে পারি; কেবল আমাদের আত্মার যে শক্তিকে ঈশ্বর আমাদের জীবনমৃত্যুর নিত্যসম্বলরাপে আমাদিগকে দান করিয়াছেন, তাহার যে বাণী আমাদের সুখে-দুঃখে উত্থানে-পতনে জয়ে-পরাজয়ে চিরদিন আমাদের অন্তরাত্মায় ধ্বনিত হইতেছে, তাহার যে সম্বন্ধ নিগৃঢ়রপে নিত্যরূপে একান্তরূপে আমারই, তাহাই আজ নির্মলচিত্তে উপলব্ধি করিব ; মহাপুরুষের সমস্ত সাধনা যাহাতে সার্থক হইয়াছে, সমাপ্ত হইয়াছে— সমস্ত কর্মের খণ্ডত, সমস্ত চেষ্টার ভঙ্গুরতা, সমস্ত প্রকাশের অসম্পূর্ণতা যে-এক পরম পরিণামের মধ্যে পরিপূর্ণ হইয়াছে- সেই দিকেই আজ আমাদের শান্ত দৃষ্টিকে স্থির রাখিব। সম্প্রদায়ের লোকদিগকে এই কথা বিশেষভাবে স্মরণ তাহার স্মৃতিশিখরের উর্ধের্ব করজোড়ে সেই ধ্রুবতারার মহিমা নিরীক্ষণ করি— যে শাশ্বত জ্যোতি সম্পদবিপদের দুৰ্গম সমুদ্রপথের মধ্য দিয়া দীর্ঘদিনের অবসানে তাহার জীবনকে তাহার চরম বিশ্রামের তীর্থে উত্তীৰ্ণ করিয়া দিয়াছে। なT図 >○> ○