পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br> br রবীন্দ্র-রচনাবলী বানানো । সে দিন পড়তে পড়তে মনটার ভিতরে একটা নীরস শ্রান্তির উদ্রেক হয়ে একটা বিদ্যুপপরায়ণ সন্দেহ-শয়তানের আবির্ভাব হল । এ দিকে রাত্রিও অনেক হওয়াতে বইটা ধ্যা করে মুড়ে ধাপ করে টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে শুতে যাবার উদ্দেশে এক ফুয়ে বাতি নিবিয়ে দিলুম। দেবামাত্রই হঠাৎ চারি দিকের সমস্ত খোলা জানলা থেকে বোটের মধ্যে জ্যোৎস্না একেবারে ভেঙে পড়ল। হঠাৎ যেন আমার চমক ভেঙে গেল । আমার ক্ষুদ্র একরাত্তি বাতির শিখা শয়তানের মতো নীরস হাসি হাসছিল, অথচ সেই অতিক্ষুদ্র বিদ্রুপহাসিতে এই বিশ্বব্যাপী গভীর প্রেমের অসীম আনন্দচ্ছটাকে একেবারে আড়াল করে রেখেছিল । নীরস গ্রন্থের বাক্যরাশির মধ্যে কী খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম ! সে কতক্ষণ থেকে সমস্ত আকাশ পরিপূর্ণ করে নিঃশব্দে বাইরে দাড়িয়ে ছিল । যদি দৈবাৎ না দেখে অন্ধকারের মধ্যে শুতে যৌতুম তা হলেও সে আমার সেই ক্ষুদ্র বাতির ব্যঙ্গের কিছুমাত্র প্রতিবাদ না করে নীরবেই নিলীন হয়ে যেত । যদি ইহজীবনে নিমেষের জন্য তাকে না দেখতে পেতুম এবং শেষরাত্রের অন্ধকারে শেষবারের মতো শুতে যে তুম তা হলেও সেই বাতির আলোরই জিত থেকে যেত ; অথচ সে বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে সেইরকম নীরবে সেইরকম মধুর মুখেই হাস্য করত— আপনাকে গোপন করত না, আপনাকে প্ৰকাশও করত না । [শিলাইদহ, ১২ ডিসেম্বর ১৮৯৫] --ছিন্নপত্ৰ চারুচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত পত্রে রবীন্দ্ৰনাথ উর্বশীর যে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন তাহা নিমে সংকলিত হইল— উর্বশী যে কী, কোনো ইংরেজি তাত্ত্বিক শব্দ দিয়ে তার সংজ্ঞা নির্দেশ করতে চাই নে, কাব্যের মধ্যেই তার অর্থ আছে । এক হিসাবে সৌন্দর্যমাত্রই অ্যাবসট্র্যাকটু— সে তো বস্তু নয়, সে একটা প্রেরণা যা আমাদের অন্তরে রসসঞ্চার করে । নারীর মধ্যে সৌন্দর্যের যে প্ৰকাশ উর্বশী তারই প্ৰতীক । সে সৌন্দর্য আপনাতেই আপনার চরম লক্ষ্য- সেইজন্য কোনো কর্তব্য যদি তার পথে এসে পড়ে তবে সে কর্তব্য বিপর্যস্ত হয়ে যায় । এর মধ্যে কেবল অ্যাবসট্র্যাকটু সৌন্দর্যের টান আছে তা নয়, কিন্তু যেহেতু নারীরূপকে অবলম্বন করে এই সৌন্দর্য সেইজন্যে তার সঙ্গে স্বভাবত নারীর মোেহও আছে। শেলি যাকে ইনটেলেকচুয়াল বিউটি বলেছেন, উর্বশীর সঙ্গে তাকেই অবিকল মেলাতে গিয়ে যদি ধাধা লাগে। তবে সেজন্যে আমি দায়ী নই। গোড়ার লাইনে আমি যার অবতারণা করেছি। সে ফুলও নয়, প্ৰজাপতিও নয়, চাদও নয়, গানের সুরও নয়— সে নিছক নারী—— মাত কন্যা বা গৃহিণী সে নয়- যে নারী সাংসারিক সম্বন্ধের অতীত, মোহিনী, সেই । মনে রাখতে হবে উর্বশী কে । সে ইন্দ্রের ইন্দ্ৰাণী নয়, বৈকুণ্ঠের লক্ষ্মী নয়, সে স্বগের নর্তকী, দেবলোকের অমৃতপানসভার সখী । দেবতার ভোগ নারীর মাংস নিয়ে নয়, নারীর সৌন্দর্য নিয়ে । হােক-না সে দেহের সৌন্দর্য, কিন্তু সেই তো সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা । সৃষ্টিতে এই রূপসৌন্দর্যের চরমতা মানবেরই রূপে । সেই মানবরূপের চরমতাই স্বগীয় । উর্বশীতে সেই দেহসৌন্দৰ্য ঐকান্তিক হয়েছে, অমরাবতীর উপযুক্ত হয়েছে। সে যেন চিরযৌবনের পাত্রে রূপের অমৃত ; তার সঙ্গে কল্যাণ মিশ্রিত নেই । সে অবিমিশ্র মাধুর্য। কামনার সঙ্গে লালসার পার্থক্য আছে । কামনায় দেহকে আশ্রয় করেও ভাবের প্রাধান্য, লালসায় বস্তুর প্রাধান্য । রসবোধের সঙ্গে পেটুকতার যে তফাত এতেও সেই তফাত । ভোজনরসিক যে, ভোজ্যকে অবলম্বন করে এমন কিছু সে আস্বাদন করে যাতে তার রুচির উৎকর্ষ সপ্ৰমাণ করে । পেটুক যে, তার ভোগের আদর্শ পরিমাণগত, রসগত নয় । সৌন্দর্যের যে আদর্শ নারীতে পরিপূর্ণতা পেয়েছে। যদিও তা দেহ থেকে বিশ্লিষ্ট নয়, তবুও তা অনির্বচনীয়।