পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গৃহপ্ৰবেশ »ዓ(፩ মাসি। তোদের বাড়িতে কারও কি কখনাে বিপদ-আপদ কিছু ঘটে নি। : মণি । আমি তো কখনো দেখি নি। এই বাড়িতে এসে প্রথম মৃত্যু দেখলুম। কেবলই ইচ্ছে করছে, ছাড়া পাই, কোথাও চলে যাই। মালিশের গন্ধ পেলে মনে হয়, বাতাসকে যেন ইসপাতালের ভূতে পেয়েছে। মাসি ; তোর যদি এমনিই মেজাজ হয় তা হলে তোকে নিয়ে সংসারেমণি । জানি নে। আমাকে তোমাদের বাগানের মালী করে দাও-না- “সে আমি ঠিক পারব | [দ্রকৃত প্ৰস্থান হিম। দেখো মাসি, বউদিদির এমন স্বভাব যে চেষ্টা করেও রাগ করতে পারি নে। মনে হয় যেন বিধাতা ওর উপরে কোনো দায় দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান নি। ওর কাছে দুঃখকষ্ট্রের কোনো মানেই নেই। মসি । ভগবান ওর বাইরের দিকটা বহু যত্নে গড়তে গিয়ে ভিতরের দিকটা শেষ করবার এখনো সময় পান নি। তোর দাদার এই বাড়ির মতো আর-কি। খুব ঘটা করে আরম্ভ করেছিল- বাইরের মহল শেষ হতে হতেই দেউলে— ভিতরের মহলের ভারা আর নামল না। আজ ওকে কেবলই ভোলাতে হচ্ছে। বাড়িটাকে নিয়েও, মণিকে নিয়েও । হিমি। বুঝতে পারি নে, এটা কি আমাদের ভালো হচ্ছে। মাসি। কী জানিস, হিমি ? মৃত্যু যখন সামনে, তখন ঘর তৈরি সারা হােক না-হােক, কী এল গেল। তাই ওকে বলি, একান্তমনে সংকল্প করেছ যা সেইটেই সম্পূর্ণ হয়েছে। হিমি, সেইটেই তো সত্য। হিমি । বাড়িটা যেন তাই হল। কিন্তু বিউদিদি ? মাসি। হিমি, তোর বউদিদিকে যিনি সুন্দর করেছেন, তীর সংকল্পের মধ্যে ও সম্পূর্ণ। চিরদিনের যে-মণি, ভগবানের আপনি বুকের ধন যে-মণি সেই তো কৌস্তভরত্ন— তার মধ্যে কোথাও কোনো খুঁত নেই। মৃত্যুকালে যতীন বিধাতার সেই মানসের মণিকেই দেখে যাক । হিম । মাসি, তোমার কথা শুনলে আমার মন আলোয় ভরে ওঠে। মাসি। হিমি, আমি কেবল কথাই বলি, কিন্তু বউয়ের উপরে রাগ করতেও ছাড়ি নে। সব বুঝি, তবু ক্ষমাও করতে পারি নে। কিন্তু হিমি, তুই যে ঐ বলল, তোর বউদিদির উপর রাগ করতে পারিস নে, তাতেই বুঝলুম, তুই যতীনেরই বােন বটে। যাই যতীনের কাছে। [প্ৰস্থান রোগীর ঘরে যতীন। মাসি, তেতলার ঘরের সব পাথর বসানো হয়ে গেছে ? মসি । হা, কাল হয়ে গেছে সব। যতীন । যাক, এতদিন পরে শেষ হয়ে গেল। আমার কতকালের ঘরবাধা সারা হল, আমার কতদিনের স্বপ্ন । মাসি। কত লোক দেখতে আসছে তোর এই বাড়িটা, যতীন।” যতীন। তারা বাইরে থেকে দেখছে, আমি ভিতরে থেকে যা দেখতে পাচ্ছি তা এখনো শেষ হয় নি। কোনােকালে শেষ হবে না। কল্পলোকের শেষ পাথরটি বসিয়ে আজ পর্যন্ত কোন শিল্পী বলেছে, এ আমার সাঙ্গ হল ? বিশ্বের সৃষ্টিকর্তও বলতে পারেন নি, তারও কাজ চলছে। মাসি। যতীন, কিন্তু আর না বাবা, এইবার তুই একটু ঘুমে। যতীন। না মাসি, আজ তুমি আমাকে সকাল সকাল ঘুমোতে বােলো নামাসি | কিন্তু ডাক্তারযতীন। থাক ডাক্তার। আজ আমার জগৎ তৈরি হয়ে গেল। আজ আমি ঘুমোব না- আজ বাড়ির সব আলোগুলো জেলে দাও, মাসি । মণি কোথায় । তাকে একবার মাসি। তাকে সেই তেতালার নতুন ঘরটায় ফুল দিয়ে সাজিয়ে বসিয়ে দিয়েছি। যতীন। এ তোমার মাথায় কী করে এল। ভারি চমৎকার। দরজার দুধারে মঙ্গলঘট দিয়েছ ? মাসি। হঁয়, দিয়েছি বৈকি।