পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१३६ गा ہo A শয়নগৃহে দীপ জ্বালা নাই। হেমন্ত বাতায়নের কাছে খাটের উপরে বসিয়া সম্মুখের অন্ধকারের দিকে চাহিয়া আছে। কুসুম ভূমিতলে দুইহাতে তাহারাপা জড়াইয়া পায়ের উপর মুখ রাখিয়া পড়িয়া আছে। সময় যেন স্তম্ভিত সমুদ্রের মতো স্থির হইয়া আছে। যেন অনন্ত নিশীথিনীর উপর অদৃষ্ট চিত্রকর এই একটি চিরস্থায়ী ছবি আঁকিয়া রাখিয়ছে- চারিদিকে প্ৰলয়, মাঝখানে একটি বিচারক এবং তাহার পায়ের কাছে একটি অপরাধিনী । আবার চটিজুতার শব্দ হইল। হরিহর মুখুজ্যে দ্বারের কাছে আসিয়া বলিলেন, “অনেকক্ষণ হইয়া গিয়াছে, আর সময় দিতে পারি না। মেয়েটাকে ঘর হইতে দূর করিয়া দাও।” । কুসুম এই স্বর শুনিবামাত্র একবার মুহুর্তের মতো চিরজীবনের সাধ মিটাইয়া হেমন্তের দুই পা দ্বিগুণতর আবেগে চাপিয়া ধরিল— চরণ চুম্বন করিয়া পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া পা ছাড়িয়া দিল। হেমন্ত উঠিয়া গিয়া পিতাকে বলিল, “আমি স্ত্রীকে ত্যাগ করিব না।” হরিহর গর্জিয়া উঠিয়া কহিল, “জাত খোয়াইবি ?” হেমন্ত কহিল, “আমি জাত মানি না।” “তবে তুইসুদ্ধ দূর হইয়া যা।”

  • বৈশাখ ১২৯৯

একরাত্রি সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি, এবং বউ-বাউ খেলিয়াছি। তাঁহাদের বাড়িতে গেলে সুরবালার মা আমাকে বড়ো যত্ন করিতেন এবং আমাদের দুইজনকে একত্র করিয়া আপনা-আপনি বলাবলি করিতেন, “আহা, দুটিতে বেশ মানায়।” ছোটাে ছিলাম। কিন্তু কথাটার অর্থ একরকম বুঝিতে পরিতাম। সুরবালার প্রতি যে সর্বসাধারণের অপেক্ষা । আমার কিছু বিশেষ দাবি ছিল, সে ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হইয়া গিয়াছিল। সেই অধিকারমদে মত্ত হইয়া তাহার প্রতি যে আমি শাসন এবং উপদ্রব না করিতাম তাহা নহে। সেও সহিষ্ণুভাবে আমার সকলরকম ফরমাশ খাটিত এবং শান্তি বহন করিত। পাড়ায় তাহার রূপের প্রশংসা ছিল, কিন্তু বর্বর বালকের চক্ষে সে সৌন্দর্যের কোনো গীেরব ছিল না- আমি কেবল জানিতাম, সুরবালা আমারই প্ৰভুত্ব স্বীকার করিবার জন্য পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, এইজন্য সে আমার বিশেষরূপ অবহেলার পাত্র। আমার পিতা চৌধুরী জমিদারের নায়েব ছিলেন। তঁহার ইচ্ছা ছিল, আমার হাতটা পাকিলেই আমাকে জমিদারি-সেরেস্তার কাজ শিখাইয়া একটা কোথাও গোমস্তগিরিতে প্ৰবৃত্ত করাইয়া দিবেন। কিন্তু আমি মনে মনে তাহাতে নারাজ ছিলাম। আমাদের পাড়ার নীলরতন যেমন কলিকাতায় পালাইয়া লেখাপড়া শিখিয়া । কালেক্টর সাহেবের নাজির হইয়াছে, আমারও জীবনের লক্ষ্য সেইরূপ অত্যুচ্চ ছিল- কালেক্টরের নজির না হইতে পারি তো জজ-আদালতের হেডক্লার্ক হইব, ইহা আমি মনে মনে নিশ্চয় স্থির করিয়া খিয়ছিলাম সর্বদাই দেখিতাম, আমার বাপ উক্ত আদালতজীবী দিগকে অত্যন্ত সম্মান করিতেন- নানা উপলক্ষে । মাছটা তরকারিটা টাকাটা সিকেটা লইয়া যে তঁহাদের পূজাৰ্চনা করিতে হইত। তাহাও শিশুকাল হইতে আমার জানা ছিল, এইজন্য আদালতে ছোটাে কর্মচারী এমনকি, পেয়াদাগুলাকে পর্যন্ত হৃদয়ের মধ্যে খুব একটা , সন্ত্রমের আসন দিয়ছিলাম। ইহারা আমাদের বাংলাদেশের পূজ্য দেবতা। তেত্ৰিশ কোটির ছোটাে ছোটাে নূতন সংস্করণ। বৈষয়িক সিদ্ধিলাভ সম্বন্ধে স্বয়ংসিদ্ধিদাতা গণেশ অপেক্ষা ইহাদের প্রতি লোকের আন্তরিক নির্ভর ঢের বেশি।- সুতরাং পূর্বে গণেশের যাহা-কিছু পাওনা ছিল, আজকাল ইহারাই তাহ সমস্ত পাইয়া থাকেন ।