পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ Vys প্রথমে মনে হইল, বাড়ি ফিরিয়া যাইতে হইবে। কিন্তু তখনই ভাবিল, আমি তো বঁচিয়া নাই, আমাকে বাড়িতে লইবে কেন। সেখানে যে অমঙ্গল হইবে। জীবরাজ্য হইতে আমি যে নির্বাসিত হইয়া আসিয়াছিআমি যে আমার প্ৰেতাত্মা । তাই যদি না হইবে তবে সে এই অর্ধরাত্রে শারদাশংকরের সুরক্ষিত অন্তঃপুর হইতে এই দুৰ্গম শ্মশানে আসিল কেমন করিয়া। এখনাে যদি তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ না হইয়া থাকে। তবে দাহ করিবার লোকজন গেল কোথায় ? শারদাশংকরের আলোকিত গৃহে তাহার মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত মনে পড়িল, তাহার পরেই এই বহুদূরবতী জনশূন্য অন্ধকার শ্মশানের মধ্যে আপনাকে একাকিনী দেখিয়া সে জানিল, আমি এই পৃথিবীর জনসমাজের আর কেহ নাহি- আমি অতি ভীষণ, অকল্যাণকারিণী ; আমি আমার প্ৰেতাত্মা । এই কথা মনে উদয় হইবামােত্রই তাহার মনে হইল, তাহার চতুর্দিক হইতে বিশ্বনিয়মের সমস্ত বন্ধন যেন ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। যেন তাহার অদ্ভুত শক্তি, অসীম স্বাধীনতা- যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারে, যাহা ইচ্ছা! করিতে পারে। এই অভূতপূর্ব নুতন ভাবের আবির্ভাবে সে উন্মত্তের মতো হইয়া হঠাৎ একটা দমকা বাতাসের মতো ঘর হইতে বাহির হইয়া অন্ধকার শ্মশানের উপর দিয়া চলিল- মনে লজ্জা ভয় ভাবনার লেশমাত্র রহিল না । চলিতে চলিতে চরণ শ্ৰান্ত, দেহ দুর্বল হইয়া আসিতে লাগিল। মাঠের পর মাঠ আর শেষ হয় না- মাঝে মাঝে ধান্যক্ষেত্ৰ- কোথাও বা একহাঁটু জল দাড়াইয়া আছে। যখন ভোরের আলো অল্প অল্প দেখা দিয়াছে তখন অদূরে লোকালয়ের বঁাশঝাড় হইতে দুটা-একটা পাখির ডাক শুনা গেল। তখন তাহার কেমন ভয় করিতে লাগিল। পৃথিবীর সহিত জীবিত মনুয্যের সহিত এখন তাহার কিরূপ নূতন সম্পর্ক দাড়াইয়াছে সে কিছু জানে না। যতক্ষণ মাঠে ছিল, শ্মশানে ছিল, শ্রাবণরজনীর অন্ধকারের মধ্যে ছিল ততক্ষণ সে যেন নিৰ্ভয়ে ছিল, যেন আপন রাজ্যে ছিল। দিনের আলোকে লোকালয় তাহার পক্ষে অতি ভয়ংকর স্থান বলিয়া বােধ হইল। মানুষ ভূতকে ভয় করে, ভূতও মানুষকে ভয় করে, মৃত্যু নদীর দুই পারে দুইজনের বাস। তৃতীয় পরিচ্ছেদ কাপড়ে কাদা মাখিয়া, অদ্ভুত ভাবের বশে ও রাত্ৰিজাগরণে পাগলের মতো হইয়া, কাদম্বিনীর যেরূপ চেহারা হইয়াছিল তাহাতে মানুষ তাহাকে দেখিয়া ভয় পাইতে পারিত এবং ছেলেরা বােধ হয় দূরে পালাইয়া গিয়া তাহাকে ঢেলা মারিত। সৌভাগ্যক্রমে একটি পথিক ভদ্রলোক তাহাকে সর্বপ্রথমে এই অবস্থায় দেখিতে 어 | সে আসিয়া কহিল, “মা, তোমাকে ভদ্রকুলবধু বলিয়া বােধ হইতেছে, তুমি এ অবস্থায় একলা পথে কোথায় চলিয়ােছ।” কাদম্বিনী প্রথমে কোনাে উত্তর না দিয়া তাকাইয়া রহিল। হঠাৎ কিছুই ভাবিয়া পাইল না। সে যে সংসারের মধ্যে আছে, তাহাকে যে ভদ্রকুলবধূর মতো দেখাইতেছে, গ্রামের পথে পথিক তাহাকে যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছে, এ-সমস্তই তাহার কাছে অভাবনীয় বলিয়া বোধ হইল । পথিক তাহাকে পুনশ্চ কহিল, “চলো মা, আমি তোমাকে ঘরে পীেছাইয়া দিই।- তোমার বাড়ি কোথায় আমাকে বলে ।” কাদম্বিনী চিন্তা করিতে লাগিল। শ্বশুরবাড়ি ফিরিবার কথা মনে স্থান দেওয়া যায় না, বাপের বাড়ি তো নাই- তখন ছেলেবেলার সাইকে মনে পড়িল । সই যোগমায়ার সহিত যদিও ছেলেবেলা হইতেই বিচ্ছেদ তথাপি মাঝে মাঝে চিঠিপত্র চলে । দিকেই প্রবল, যোগমায়া জানাইতে চাহে কাদম্বিনী তাহারা ভালোবাসার যথোপযুক্ত প্রতিদান দেয় না। কোনো সুযোগে একবার উভয়ে মিলন হইতে পারিলে যে একদণ্ড কেহ কাহাকে চোখের আড়াল করিতে পরিবে না, এ বিষয়ে কোনো পক্ষেরই কোনো সন্দেহ ছিল না।