পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

帘3页 VOSKO “কিন্তু আমি মরিয়াছি ছাড়া তোমাদের কাছে আর কী অপরাধ করিয়াছি। আমার যদি ইহলোকেও স্থান নাই পরলোকেও স্থান নাই- ওগো, আমি তবে কোথায় যাইব ।” তীব্ৰকণ্ঠে চীৎকার করিয়া যেন এই গভীর বৰ্যনিশীথে সুপ্ত বিধাতাকে জাগ্ৰত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল- “ওগো, আমি তবে কোথায় যাইব ।” এই বলিয়া মূৰ্ছিত দম্পতিকে অন্ধকার ঘরে ফেলিয়া বিশ্বজগতে কাদম্বিনী আপনার স্থান খুঁজতে গেল। পঞ্চম পরিচ্ছেদ কাদম্বিনী যে কেমন করিয়া রানীহাটে ফিরিয়া গেল, তাহা বলা কঠিন। কিন্তু প্ৰথমে কাহাকেও দেখা দিল না । সমস্ত দিন অনাহারে একটা ভাঙা পোড়ো মন্দিরে যাপন করিল। বর্ষার অকাল সন্ধ্যা যখন অত্যন্ত ঘন হইয়া আসিল এবং আসন্ন দুর্যোগের আশঙ্কায় গ্রামের লোকেরা ব্যস্ত । হইয়া আপন আপন গৃহ আশ্রয় করিল তখন কাদম্বিনী পথে বাহির হইল। শ্বশুরবাড়ির দ্বারে গিয়া একবার তাহার হৃৎকম্প উপস্থিত হইয়াছিল। কিন্তু মস্ত ঘোমটা টানিয়া যখন ভিতরে প্রবেশ করিল দাসীভ্ৰমে দ্বারীরা কোনোরূপ বাধা দিল না- এমন সময় বৃষ্টি খুব চাপিয়া আসিল, বাতাসও বেগে বহিতে লাগিল। তখন বাড়ির গৃহিণী শারদাশংকরের স্ত্রী তাহার বিধবা ননদের সহিত তাঁস খেলিতেছিলেন। বি ছিল রান্নাঘরে এবং পীড়িত খোকা জ্বরের উপশমে শয়নগৃহে বিছানায় ঘুমাইতেছিল। কাদম্বিনী সকলের চক্ষু এড়াইয়া সেই ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। সে যে কী ভাবিয়া শ্বশুরবাড়ি আসিয়াছিল জানি না, সে নিজেও জানে না, কেবল এইটুকু জানে যে একবার খোকাকে চক্ষে দেখিয়া যাইবার ইচ্ছা। তাহার পর কোথায় যাইবে, কী হইবে, সে কথা সে ভাবেও নাই। দীপালোকে দেখিল রুগণ শীর্ণ খোকা হাত মুঠা করিয়া ঘুমাইয়া আছে। দেখিয়া উত্তপ্ত হৃদয় যেন তৃষাতুর হইয়া উঠিল— তাহার সমস্ত বালই লইয়া তাহাকে একবার বুকে চাপিয়া না ধরিলে কি বাচা যায়। আর, তাহার পর মনে পড়িল, “আমি নাই, ইহাকে দেখিবার কে আছে। ইহার মা সঙ্গ ভালোবাসে, গল্প ভালোবাসে, খেলা ভালোবাসে, এতদিন আমার হাতে ভার দিয়াই সে নিশ্চিন্ত ছিল, কখনো তাহাকে ছেলে মানুষ করিবার কোনো দায় পোহাইতে হয় নাই। আজ ইহাকে কে তেমন করিয়া যত্ন করবে।” এমন সময় খোকা হঠাৎ পাশ ফিরিয়া অর্ধনিদ্রিত অবস্থায় বলিয়া উঠিল, “কাকিম, জল দে।” আমরিয়া যাই! সোনা আমার, তোর কাকিমাকে এখনো ভুলিস নাই! তাড়াতাড়ি কুঁজা হইতে জল গড়াইয়া লইয়া খোকাকে বুকের উপর তুলিয়া কাদম্বিনী তাঁহাকে জলপান করাইল । যতক্ষণ ঘুমের ঘোর ছিল, চিরাভ্যাসমত ককিমার হাত হইতে জল খাইতে খোকার কিছুই আশ্চর্যবোধ হইল না। অবশেষে কাদম্বিনী যখন বহুকালের আকাঙক্ষা মিটাইয়া তাহার মুখচুম্বন করিয়া তাহাকে আবার শুয়াইয়া দিল, তখন তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল এবং কাকিমকে জড়াইয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কাকিম, তুই মরে গিয়েছিলি ?” কাকিমা কহিল, “ই খোকা ।” i “আবার তুই খোকার কাছে ফিরে এসেছিস ? আর তুই মরে যাবি নে ?” ইহার উত্তর দিবার পূর্বেই একটা গােল বাধিল-ঝি একবাটি সাপ্ত হাতে করিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল, হঠাৎ বাটি ফেলিয়া মাগো বলিয়া আছাড় খাইয়া পড়িয়া গেল। চীৎকার শুনিয়া তাস ফেলিয়া গিন্নি ছুটিয়া আসিলেন, ঘরে ঢুকিতেই তিনি একেবারে কাঠের মতো হইয়া গেলেন, পলাইতেও পারিলেন না, মুখ দিয়া একটি কথাও সরিল না। এই সকল ব্যাপার দেখিয়া খোকারও মনে ভয়ের সঞ্চার হইয়া উঠিল- সে কঁদিয়া বলিয়া উঠিল, “কাকিম, তুই যা।” কাদম্বিনী অনেকদিন পরে আজ অনুভব করিয়াছে যে সে মরে নাই- সেই পুরাতন ঘরদ্বার, সেইসমস্ত, সেই খোকা, সেই স্নেহ, তাহার পক্ষে সমান জীবন্তভাবেই আছে, মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ কোনো ব্যবধান