পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া বসিয়াছেন। অর্থাভাবসত্বে উপযুক্ত গহনা কোথায় পাওয়া যাইবে বলিয়া বৈদ্যনাথ উক্ত প্রস্তাবে আপত্তি করিতেছেন ; বিধবার গহনা আবশ্যক করে না বলিয়া পত্নী আপত্তি খণ্ডন করিতেছেন। তাহার কী একটা চূড়ান্ত জবাব আছে বলিয়া ঠাঁহার মনে হইতেছে অথচ কিছুতেই মাথায় আসিতেছে না, এমন সময় নিদ্ৰাভঙ্গ হইয়া দেখিলেন সকাল হইয়াছে; এবং কেন যে তাহার স্ত্রীর বিধবাবিবাহ হইতে পারে না, তাহার সদুত্তর তৎক্ষণাৎ মনে পড়িয়া গেল এবং সেজন্য বােধ করি কিঞ্চিৎ দুঃখিত হইলেন। পরদিন প্ৰাত:কৃত্য সমাপন করিয়া একাকী বসিয়া ঘুড়ির লখ তৈরি করিতেছেন, এমন সময় এক সন্ন্যাসী জয়ধ্বনি উচ্চারণ করিয়া দ্বারে আগত হইল। সেই মুহূর্তেই বিদ্যুতের মতো বৈদ্যনাথ ভাবী ঐশ্বর্যের উজ্জ্বল মূর্তি দেখিতে পাইলেন। সন্ন্যাসীকে প্রচুর পরিমাণে আদর-অভ্যর্থনা ও আহার্য জোগাইলেন। অনেক সাধ্যসাধনার পর জানিতে পারিলেন, সন্ন্যাসী সোনা তৈরি করিতে পারে এবং সে-বিদ্যা তাহাকে দান করিতেও সে অসম্মত হইল না । গৃহিণীও নাচিয়া উঠিলেন। যকৃতের বিকার উপস্থিত হইলে লোকে যেমন সমস্ত হলুদবৰ্ণ দেখে, তিনি সেইরূপ পৃথিবীময় সোনা দেখিতে লাগিলেন। কল্পনা-কারিকরের দ্বারা শয়নের খাট, গৃহসজ্জা এবং গৃহপ্ৰাচীর পর্যন্ত সোনায় মণ্ডিত করিয়া মনে মনে বিন্ধ্যবাসিনীকে নিমন্ত্ৰণ করিলেন। সন্ন্যাসী প্রতিদিন দুই সেরা করিয়া দুগ্ধ এবং দেড় সেরা করিয়া মোহনভোগ খাইতে লাগিল এবং বৈদ্যনাথের কোম্পানির কাগজ দোহন করিয়া অজস্র রৌপ্যরস নিঃসৃত করিয়া লইল । ছিপ ছড়ি লাটাইয়ের কাঙালিরা বৈদ্যুনাথের রুদ্ধদ্বারে নিম্ফল আঘাত করিয়া চলিয়া যায়। ঘরে ছেলেগুলো যথাসময়ে খাইতে পায় না, পড়িয়া গিয়া কপাল ফুলায়, কঁদিয়া আকাশ ফাটাইয়া দেয়, কর্তা গৃহিণী কাহারও ভুক্ষেপ নাই। নিস্তব্ধভাবে অগ্নিকুণ্ডের সম্মুখে বসিয়া কটাহের দিকে চাহিয়া উভয়ের চােখে পল্লব নাই, মুখে কথা নাই। তৃষিত একাগ্রনেত্ৰে অবিশ্রাম অগ্নিশিখার প্রতিবিম্ব পড়িয়া চােখের মণি যেন স্পর্শমণির গুণপ্রাপ্ত হইল। দৃষ্টিপথ সায়াহ্নের সূর্যস্তপথের মতো জ্বলন্ত সুবর্ণপ্রলেপে রাঙা হইয়া উঠিল। দুখানা কোম্পানির কাগজ এই স্বর্ণ অগ্নিতে আহুতি দেওয়ার পর একদিন সন্ন্যাসী আশ্বাস দিল, “কাল সোনার রঙ ধরিবে ।” সেদিন রাত্রে আর কাহারও ঘুম হইল না ; স্ত্রীপুরুষে মিলিয়া সুবর্ণপুরী নির্মাণ করিতে লাগিলেন । তৎসম্বন্ধে মাঝে মাঝে উভয়ের মধ্যে মতভেদ এবং তর্কও উপস্থিত হইয়াছিল। কিন্তু আনন্দ-আবেগে তাহার মীমাংসা হইতে বিলম্ব হয় নাই। পরস্পর পরস্পরের খাতিরে নিজ নিজ মত কিছু কিছু পরিত্যাগ করিতে অধিক ইতস্তত করেন নাই, সে রাত্রে দাম্পত্য-একীকরণ এত ঘনীভূত হইয়া উঠিয়ছিল। পরদিন আর সন্ন্যাসীর দেখা নাই। চার দিক হইতে সোনার রঙ ঘুচিয়া গিয়া সূৰ্যকিরণ পর্যন্ত অন্ধকার হইয়া দেখা দিল । ইহার পর হইতে শয়নের খািট গৃহসজ্জা এবং গৃহপ্রাচীর চতুর্থণ দারিদ্র্য এবং জীর্ণতা প্রকাশ করিতে লাগিল । এখন হইতে গৃহকাৰ্যে বৈদ্যনাথ কোনো একটা সামান্য মত প্রকাশ করিতে গেলে গৃহিণী তীব্রমধুরস্বরে বলেন, “বুদ্ধির পরিচয় অনেক দিয়াছ, এখন কিছুদিন ক্ষান্ত থাকো ” বৈদ্যনাথ একেবারে নিবিয়া যায়। মোক্ষদা এমনি একটা শ্রেষ্ঠতার ভােব ধারণ করিয়াছে যেন এই স্বর্ণমরীচিকায় সে নিজে এক মুহুর্তের अन्IN3 उाश्ठ श नाश् । অপরাধী বৈদ্যনাথ স্ত্রীকে কিঞ্চিৎ সন্তুষ্ট করিবার জন্য বিবিধ উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন । একদিন একটি চতুষ্কোণ মোড়কে গোপন উপহার লইয়া স্ত্রীর নিকট গিয়া প্রচুর হাস্যবিকাশপূর্বক সাতিশয় চতুরতার সহিত ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “কী আনিয়াছি বলে দেখি ” স্ত্রী কৌতুহল গোপন করিয়া উদাসীনভাবে কহিলেন, “কেমন করিয়া বলিব, আমি তো আর 'জান নহি ।” বৈদ্যনাথ অনাবশ্যক কালব্যয় করিয়া প্রথমে দড়ির গাঠ অতি ধীরে ধীরে খুললেন, তার পর ফু দিয়া কাগজের ধূলা ঝাড়িলেন, তাহার পর অতি সাবধানে এক এক ভঁাজ করিয়া কাগজের মোড়ক খুলিয়া আর্ট স্টুডিয়ের রঙ করা দশমহাবিদ্যার ছবি বাহির করিয়া আলোর দিকে ফিরাইয়া গৃহিণীর সম্মুখে ধরলেন।