পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sr রবীন্দ্র-রচনাবলী অবিনাশ তৎক্ষণাৎ উত্তর করিল, “একটা নীেকো দিয়ে বাবা।” ছোটােটিও মনে করিল, বড়ো ভাইয়ের চেয়ে কোনো বিষয়ে নতুন হওয়া কিছু নয়, কহিল, “আমাকেও একটা নীেকো দিয়ো বাবা ।” | বাপের উপযুক্ত ছেলে! একটা অকৰ্মণ্যকারুকার্যপাইলে আর কিছু চাহে না। বাপাবলিলেন, “আচ্ছা।” এদিকে যথাকলে পূজার ছুটিতে কাশী হইতে মোক্ষদার এক খুড়া বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। তিনি ব্যবসায়ে উকিল। মোক্ষদা কিছুদিন ঘন ঘন তাহার বাড়ি যাতায়াত করিলেন। অবশেষে একদিন স্বামীকে আসিয়া বললেন, “ওগে, তােমাকে কাশী যাইতে হইতেছে।” বৈদ্যনাথ সহসা মনে করিলেন, বুঝি তাহার মৃত্যুকাল উপস্থিত, গণক কোষ্ঠী হইতে আবিষ্কার করিয়াছে ; সহধর্মিণী সেই সন্ধান পাইয়া তাহার সদগতি করিবার যুক্তি করিতেছেন। পরে শুনিলেন, এইরূপ জনশ্রুতি যে কাশীতে একটি বাড়ি আছে সেখানে গুপ্তধন মিলিবার কথা, সেই বাড়ি কিনিয়া তাহার ধন উদ্ধার করিয়া আনিতে হইবে। - বৈদ্যনাথ বলিলেন, “কী সর্বনাশ। আমি কাশী যাইতে পারিব না।” বৈদ্যনাথ কখনাে ঘর ছাড়িয়া কোথাও যান নাই। গৃহস্থকে কী করিয়া ঘরছাড়া করিতে হয়, প্রাচীন শাস্ত্রকারগণ লিখিতেছেন, স্ত্রীলোকের সে সম্বন্ধে 'অশিক্ষিত পটুত্ব আছে। মোক্ষদা মুখের কথায় ঘরের মধ্যে যেন লঙ্কার ধোয়া দিতে পারিতেন, কিন্তু তাহাতে হতভাগ্য বৈদ্যনাথ কেবল চোখের জলে ভাসিয়া যাইত, কাশী যাইবার নাম করিত না । দিন দুই-তিন গেল। বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া কতকগুলা কাষ্ঠখণ্ড কাটিয়া কুঁদিয়া জোড়া দিয়া দুইখানি খেলনার নীেকা তৈরি করিলেন। তাহাতে মাস্তুল বসাইলেন, কাপড় কাটিয়া পাল আঁটিয়া দিলেন ; লাল শালুর নিশান উড়াইলেন, হাল ও দাঁড় বসাইয়া দিলেন। একটি পুতুল কর্ণধার এবং আরোহীও ছাড়িলেন না। তাহাতে বহু যত্ন এবং আশ্চর্য নিপুণতা প্রকাশ করিলেন। সে নীেক দেখিয়া অসহ্য চিত্তচাঞ্চল্য না জন্মে এমন সংযতচিত্ত বালক সম্প্রতি পাওয়া দুর্লভ। অতএব বৈদ্যনাথ সপ্তমীর পূর্বরাত্রে যখন নীেকাদুটি লইয়া ছেলেদের হাতে দিলেন, তাহারা আনন্দোেনচিয়া উঠিল। একে তো নীেকার খোলটাই যথেষ্ট, তাহাতে আবার হাল আছে, দাড় আছে, মাস্তুল আছে, পাল আছে, আবার যথাস্থানে মাঝি বসিয়া, ইহাই তাঁহাদের সমধিক বিস্ময়ের কারণ হইল । ছেলেদের আনন্দকলরবে আকৃষ্ট হইয়া মোক্ষদা আসিয়া দরিদ্র পিতার পূজার উপহার দেখিলেন। দেখিয়া, রাগিয়া কঁাদিয়া কপালে করাঘাত করিয়া খেলনা।দুটাে কড়িয়া জানলার বাহিরে টুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন। সোনার হার গেল, সাটিনের জামা গেল, জরির টুপি গেল, শেষে কিনা হতভাগ্য মনুষ্য দুইখানা খেলনা দিয়া নিজের ছেলেকে প্রতারণা করিতে আসিয়াছে। তাও আবার দুই পয়সা ব্যয় নাই, নিজের হাতে ०ि | ছোটো ছেলে তো উর্ধ্বশ্বাসে কাদিতে লাগিল। ‘বোকা ছেলে বলিয়া তাহাকে মোক্ষদা। ঠাস করিয়া চড়াইয়া দিলেন । , বড়ো ছেলেটি বাপের মুখের দিকে চাহিয়া নিজের দুঃখ ভুলিয়া গেল। উল্লাসের ভানমােত্র করিয়া কহিল, “বাবা, আমি কাল ভোরে গিয়ে কুড়িয়ে নিয়ে আসব।” বৈদ্যনাথ তাহার পরদিন কাশী যাইতে সম্মত হইলেন । কিন্তু টাকা কোথায়। র্তাহার স্ত্রী গহনা বিক্রয় করিয়া টাকা সংগ্ৰহ করিলেন। বৈদ্যনাথের পিতামহীর আমলের গহনা, এমন খাটি সোনা এবং ভাৱী গহনা আজকালকার দিনে পাওয়াই যায় না। S বৈদ্যনাথের মনে হইল তিনি মরিতে যাইতেছেন। ছেলেদের কোলে করিয়া চুম্বন করিয়া সাশ্রুনেত্ৰে বাড়ি হইতে বাহির হইলেন। তখন মোক্ষদও কঁদিতে লাগিলেন।