পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ SSS অনেকক্ষণ পরে মোক্ষদা কোনো কথা না বলিয়া ধীরে ধীরে শয়নগৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং ভিতর হইতে দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিলেন। বৈদ্যনাথ চুপ করিয়া বাহিরে দাড়াইয়া রহিলেন। চৌকিদার প্রহর হাঁকিয়া গেল। শ্ৰান্ত পৃথিবী অকাতর নিদ্রায় মগ্ন হইয়া রহিল। আপনার আত্মীয় হইতে আরম্ভ করিয়া অনন্ত আকাশের নক্ষত্র পর্যন্ত কেহই এই লাঞ্ছিত ভগ্ননিদ্র বৈদ্যনাথকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করিল না। অনেক রাত্রে, বােধকরি কোনাে স্বপ্ন হইতে জাগিয়া,বৈদ্যনাথের বড়োছেলেটি শয্যা ছাড়িয়া আস্তে আস্তে বারান্দায় আসিয়া ডাকিল, “বাবা।” তখন তাহার বাবা সেখানে নাই। অপেক্ষাকৃত উর্ধ্বকণ্ঠে রুদ্ধদ্বারের বাহির হইতে ডাকিল, “বাবা।” কিন্তু কোনো উত্তর পাইল না । আবার ভয়ে ভয়ে বিছানায় গিয়া শয়ন করিল। " পূর্বপ্রথানুসারে ঝি সকালবেলায় তামাক সাজিয়া তীহাকে খুঁজিল, কোথাও দেখিতে পাইল না। বেলা হইলে প্রতিবেশিগণ গৃহপ্ৰত্যাগত বান্ধবের খোজ লাইতে আসিল, কিন্তু বৈদ্যনাথের সহিত সাক্ষাৎ হইল না। ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯৯ রীতিমত নভেল প্রথম পরিচ্ছেদ ‘আল্লা হাে আকবর’ শব্দে রণভূমি প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। একদিকে তিনলক্ষ যবন সেনা, অন্যদিকে তিনসহস্ৰ আৰ্যসৈন্য। বন্যার মধ্যে একাকী অশ্বখবৃক্ষের মতো হিন্দুবীরগণ সমস্ত রাত্রি এবং সমস্ত দিন যুদ্ধ করিয়া অটল দাড়াইয়া ছিল কিন্তু এইবার ভাঙিয়া পড়িবে, তাহার লক্ষণ দেখা যাইতেছে। এবং সেইসঙ্গে ভারতের জয়ধ্বজ ভূমিসাৎ হইবে এবং আজিকার ঐ অস্তাচলবতী সহস্ররশ্মির সহিত হিন্দুস্থানের গীেরবসূর্য চিরদিনের মতো অস্তমিত হইবে । হর হর বােম বােম! পাঠক বলিতে পাের, কে ঐ দৃপ্ত যুবা পঁয়ত্রিশজন মাত্র অনুচর লইয়া মুক্ত আসি হন্তে অশ্বারোহণে ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর করনিক্ষিপ্ত দীপ্ত বঞ্জের ন্যায় শত্রুসৈন্যের উপরে আসিয়া পতিত । হইল ? বলিতে পাের, কাহার প্রতাপে এই অগণিত যবনসৈন্য প্রচণ্ড বাত্যাহত অরণ্যানীর ন্যায় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল ?- কাহার বজ্ৰমন্দ্রিত হর হার বোম বোমা শব্দে তিনলক্ষ স্লেচ্ছ কণ্ঠের ‘আল্লা হাে আকবর ধ্বনি নিমগ্ন হইয়া গেল ? কাহার উদ্যত অসির সম্মুখে ব্যাঘ্র-আক্রান্ত মেষযুথের ন্যায় শত্রুসৈন্য মুহূর্তের মধ্যে উর্ধ্বশ্বাসে পলায়নপর হইল ? বলিতে পাের, সেদিনকার আর্যস্থানের সূর্যদেব সহস্ররক্তকরষ্পর্শে কাহার রক্তাক্ত তরবারিকে আশীৰ্বাদ করিয়া অস্তাচলে বিশ্রাম করিতে গেলেন ? বলিতে পার কি পাঠক । ইনিই সেই ললিতসিংহ। কান্ধীর সেনাপতি। ভারত-ইতিহাসের ধুবনক্ষত্র। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ আজ কান্ধীনগরে কিসের এত উৎসব। পাঠক জােন কি। হর্মশিখরে জয়ধ্বজা কেন এত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। কেবল কি বায়ুভরে না আনন্দভরে। দ্বারে দ্বারে কদলীতরু ও মঙ্গলঘট, গৃহে গৃহে শঙ্খধ্বনি। পথে পথে দীপমালা। পুরপ্রাচীরের উপর লোকে লোকােরণ্য। নগরের লোক কাহার জন্য এমন উৎসুক ইয়া প্রতীক্ষা করিতেছে। সহসা পুরুষকণ্ঠের জয়ধ্বনি এবং বামাকণ্ঠের হুলুধ্বনি একত্র মিশ্রিত হইয়া অভ্ৰভেদ করিয়া নির্নিমেষ নক্ষত্ৰলোকের দিকে উখিত হইল। নক্ষত্ৰশ্রেণী বায়ুব্যাহত দীপমালার ন্যায় কীপিতে লাগিল। : -