পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩৩২ রবীন্দ্র-রচনাবলী ঐ যে প্ৰমত্ত তুরঙ্গমের উপর আরোহণ করিয়া বীরবর পুরদ্বারে প্রবেশ করিতেছেন, উহাকে চিনিয়াছ কি । উনিই আমাদের সেই পূর্বপরিচিত ললিতসিংহ, কান্ধীর সেনাপতি । শত্রু নিধন করিয়া স্বীয় প্ৰভু কার্থীরাজ-পদতলে শত্রুরক্তাঙ্কিত খড়গ উপহার দিতে আসিয়াছেন। তাই এত উৎসব। কিন্তু এত যে জয়ধ্বনি, সেনাপতির সেদিকে কৰ্ণপাত নাই- গবাক্ষ হইতে পুরললনাগণ এত যে পুষ্পবৃষ্টি করিতেছেন, সেদিকে তঁহার দৃকপাত নাই। অরণ্যপথ দিয়া যখন তৃষ্ণাতুর পথিক সরোবরের দিকে ধাবিত হয় তখন শুষ্ক পত্ররাশি তাহার মাথার উপর ঝরিতে থাকিলে তিনি কি ভুক্ষেপ করেন। অধীরচিত্ত ললিতসিংহের নিকট এই অজস্র সম্মান সেই শুষ্ক পত্রের ন্যায় নীরস, লঘু ও অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হইল । অবশেষে অশ্ব যখন অন্তঃপুরপ্রাসাদের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল, তখন মুহুর্তের জন্য সেনাপতি র্তাহার বলগা আকর্ষণ করিলেন, অশ্ব মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হইল, মুহূর্তের জন্য ললিতসিংহ একবার প্রাসাদবাতায়নে তৃষিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন, মুহূর্তের জন্য দেখিতে পাইলেন দুইটি লজ্জনত নেত্র একবার চকিতের মতো তাহার মুখের উপর পড়ল এবং দুইটি অনিন্দিত বাহু হইতে একটি পুষ্পমালা খসিয়া তাহার সম্মুখে ভূতলে পতিত হইল। তৎক্ষণাৎ অশ্ব হইতে নামিয়া সেই মালা কিরািটচুড়ায় তুলিয়া লইলেন এবং আর-একবার কৃতাৰ্থ দৃষ্টিতে উর্ধে চাহিলেন। তখন দ্বার রুদ্ধ হইয়া গিয়াছে, দীপ নির্বাপিত। তৃতীয় পরিচ্ছেদ সহস্ৰ শত্রুর নিকট যে অবিচলিত, দুইটি চকিত হরিণনেত্রের নিকট সে পরাভূত। সেনাপতি বহুকাল ধৈর্যকে পাষাণদুর্গের মতো হৃদয়ে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন, গতকল্য সন্ধ্যাকালে দুটি কালো চােখের সলজ সসন্ত্রম দৃষ্টি সেই দুর্গের ভিত্তিতে গিয়া আঘাত করিয়াছে এবং এতকালের ধৈর্য মুহূর্তে ভূমিসাৎ হইয়া গেছে কিন্তু, ছিছি সেনাপতি, তাই বলিয়া কি সন্ধ্যার অন্ধকারে চোরের মতো রাজান্তঃপুরের উদ্যানপ্রাচীর লঙ্ঘন করিতে হয়। তুমিই না ভুবনবিজয়ী বীরপুরুষ ? কিন্তু যে উপন্যাস লেখে, তাহার কোথাও বাধা নাই; দ্বারীরা দ্বাররোধ করে না, অসূৰ্যাম্পশ্যরূপ রমণীরাও আপত্তি প্রকাশ করে না। অতএব এই সুরম্য বসন্তসন্ধ্যায় দক্ষিণবায়ুবীজিত রাজান্তঃপুরের নিতৃত্ব উদ্যানে একবার প্রবেশ করা যাক- হে পাঠিকা, তোমরাও আইস এবং পাঠকগণ, ইচ্ছা করিলে তোমরাও অনুবতী হইতে পাের- আমি অভয়দান করিতেছি। একবার চাহিয়া দেখাে, বকুলতলের তৃণশয্যায় সন্ধাতারার প্রতিমার মতো ঐ রমণী কে। হে পাঠক, ;ে পাঠিকা, তোমরা উহাকে জােন কি। অমন রূপ কোথাও দেখিয়াছ ? রূপের কি কখনো বর্ণনা করা যায় ভাষা কি কখনো কোনো মন্ত্রবলে এমন জীবন, যৌবন এবং লবণ্যে ভরিয়া উঠিতে পারে। হে পাঠক তোমার যদি দ্বিতীয় পক্ষের বিবাহ হয় তবে স্ত্রীর মুখ স্মরণ করো। হে রূপসী পাঠিকা, যে যুবতীকে দেখিয় তুমি সঙ্গিনীকে বলিয়াছ ইহাকে কী এমন ভালো দেখিতে, ভাই ! হউক সুন্দরী কিন্তু ভাই, তেমন শ্ৰী নাই। — তাহার মুখ মনে করে, ঐ তরুতলবর্তিনী রাজকুমারীর সহিত তাহার কিঞ্চিৎ সাদৃশ্য উপলদি করবে। পাঠক এবং পাঠিকা, এবার চিনিলে কি। উনিই রাজকন্যা বিদ্যুন্মালা। রাজকুমারী কোলের উপর ফুল রাখিয়া নতমুখে মালা গাঁথিতেছেন, সহচরী কেহই নাই। গাঁথিতে গাঁথিতে এক-একবার অঙ্গুলি আপনার সুকুমার কার্যে শৈথিল করিতেছে, উদাসীন দৃষ্টি কোন-এ অতিদূরবর্তী চিন্তারাজ্যে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেছে। রাজকুমারী কী ভাবিতেছেন। কিন্তু হে পাঠক, সে প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না। কুমারীর নিভৃত হৃদয়মন্দিরের মধ্যে আজি এই নিস্ত সন্ধ্যায় কোন মর্ত্যদেবতার আরতি হইতেছে, অপবিত্র কৌতুহল লইয়া সেখানে প্রবেশ করিতে পারিব না ঐ দেখে, একটি দীর্ঘনিশ্বাস পূজার সুগন্ধি ধূপধুমের ন্যায় সন্ধ্যার বাতাসে মিশাইয়া গেল এবং দুইফোঁ অশ্রুজােল দুটি সুকোমল কুসুমকোরকের মতো অজ্ঞাত দেবতার চরণের উদ্দেশে খসিয়া পড়িল ।