পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OV8 রবীন্দ্র-রচনাবলী S রাজকন্যার নাম অপরাজিতা । উদয়নারায়ণের সভাকবি শেখর তীহাকে কখনো চক্ষেও দেখেন নাই । কিন্তু যেদিন কোনাে নূতন কাব্য রচনা করিয়া সভাতলে বসিয়া রাজাকে শুনাইতেন, সেদিন কণ্ঠস্বর ঠিক এতটা উচ্চ করিয়া পড়িতেন যাহাতে তাহা সেই সমুচ্চ গৃহের উপরিতলের বাতায়নবর্তিনী অদৃশ্য শ্ৰোত্রীগণের কৰ্ণপথে প্রবেশ করিতে পারে। যেন তিনি কোনো-এক অগম্য নক্ষত্ৰলোকের উদেশে আপনার সংগীতোঙ্গাস প্রেরণ করতেন যেখানে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর মধ্যে র্তাহার জীবনের একটি অপরিচিত শুভগ্ৰহ অদৃশ্য মহিমায় বিরাজ করিতেছেন। কখনো ছায়ার মতন দেখিতে পাইতেন, কখনো নুপুরশিঙ্গনের মতন শুনা সাইত ; বসিয়া বসিয়া মনে মনে ভাবিতেন, সে কেমন দুইখানি চরণ যাহাতে সেই সোনার নূপুর বাধা থাকিয়া তালে তালে গান গাহিতেছে। সেই দুইখানি রক্তিম শুভ্ৰ কোমল চরণতল প্রতি পদক্ষেপে কী সৌভাগ্য কী অনুগ্রহ কী করুণার মতো করিয়া পৃথিবীকে স্পর্শ করে। মনের মধ্যে সেই চরণদুটি প্রতিষ্ঠা করিয়া কবি অবসরকালে সেইখানে আসিয়া লুটাইয়া পড়িত এবং সেই নূপুরশিঙ্গনের সুরে আপনার গান বঁধিত। কিন্তু যে-ছায়া দেখিয়ছিল, যে-নৃপুর শুনিয়াছিল, সে কাহার ছায়া, কাহার নূপুর, এমন তর্ক এমন সংশয় তাহার ভক্তহৃদয়ে কখনাে উদয় হয় নাই। রাজকন্যার দাসী মঞ্জরী যখন ঘটে যাইত, শেখরের ঘরের সম্মুখ দিয়া তাহার পথ ছিল। আসিতে যাইতে কবির সঙ্গে তাহার দুটা কথা না হইয়া যাইত না। তেমন নির্জন দেখিলে সে সকালে সন্ধ্যায় শেখরের ঘরের মধ্যে গিয়াও বসিত। যতবার সে ঘটে যাইত ততবার যে তাহার আবশ্যক ছিল, এমনও বােধ হইত না, যদি-বা আবশ্যক ছিল এমন হয়। কিন্তু ঘাটে যাইবার সময় উহারই মধ্যে একটু বিশেষ যত্ন করিয়া একটা রঙিন কাপড় এবং কানে দুইটা আম্রমুকুল পরিবার কোনো উচিত কারণ পাওয়া যাইত না । লোকে হাসােহাসি কানাকানি করিত। লোকের কোনো অপরাধ ছিল না । মঞ্জরীকে দেখিলে শেখর বিশেষ আনন্দলাভ করিতেন । তাহা গোপন করিতেও তাহার তেমন প্ৰয়াস ছিল না । , তাহার নাম ছিল মঞ্জরী ; বিবেচনা করিয়া দেখিলে সাধারণ লোকের পক্ষে সেই নামই যথেষ্ট ছিল, কিন্তু শেখর আবার আরো একটু কবিত্ব করিয়া তাহাকে বসন্তমঞ্জরী বলিতেন। লোকে শুনিয়া বলিত, “আ সর্বনাশ ।” আবার কবির বসন্তবর্ণনার মধ্যে মঞ্জুলবঙুলমঞ্জরী এমনতরো অনুপ্রাসও মাঝে মাঝে পাওয়া যাইত। এমনকি, জনরব রাজার কানেও উঠিয়াছিল। রাজা তাহার কবির এইরূপ রসাধিক্যের পরিচয় পাইয়া বড়োই আমোদবোধ করিতেন- তাহা লইয়া কৌতুক করিতেন, শেখরও তাঁহাতে যোগ দিতেন। রাজা হাসিয়া প্রশ্ন করিতেন, “ভমর কি কেবল বসন্তের রাজসভায় গান গায়-” কবি উত্তর দিতেন, “না, পুষ্পমঞ্জরীর মধুও খাইয়া থাকে।” এমনি করিয়া সকলেই হাসিত, আমোদ করিত ; বোধ করি অন্তঃপুরে রাজকন্যা অপরাজিতাও মঞ্জরীকে লইয়া মাঝে মাঝে উপহাস করিয়া থাকিবেন । মঞ্জরী তাহাতে অসন্তুষ্ট হইত না । এমনি করিয়া সত্যে মিথ্যায় মিশাইয়া মানুষের জীবন একরকম করিয়া কাটিয়া যায়- খানিকটা বিধাতা গড়েন, খানিকটা আপনি গড়ে, খানিকটা পাঁচজনে গড়িয়া দেয় ; জীবনটা একটা পাঁচমিশালি রকমের জোড়াতািড়- প্রকৃত এবং অপ্রকৃত, কাল্পনিক এবং বাস্তবিক । কেবল কবি যে-গানগুলি গাহিতেন তাঁহাই সত্য এবং সম্পূর্ণ। গানের বিষয় সেই রাধা এবং কৃষ্ণ- সেই চিরন্তন নর এবং চিরন্তন নারী, সেই অনাদি দুঃখ এবং অনন্ত সুখ । সেই গানেই তাহার যথার্থ নিজের কথা ছিল- এবং সেই গানের যথার্থ আমরাপুরের রাজা হইতে দীনদুঃখী প্ৰজা পর্যন্ত সকলেই আপনার হৃদয়ে হৃদয়ে পরীক্ষা করিয়াছিল। তঁহার গান সকলেরই মুখে। জ্যোৎস্না উঠিলেই, একটু দক্ষিণা বাতাসের