পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se 996. আভাস দিলেই, অমনি দেশের চতুর্দিকে কত কানন, কত পথ, কত নীেকা, কত বাতায়ন, কত প্রাঙ্গণ হইতে তাহার রচিত গান উচ্ছসিত হইয়া উঠিত- তাহার খ্যাতির আর সীমা ছিল না। : এইভাবে অনেকদিন কাটিয়া গেল। কবি কবিতা লিখিতেন, রাজা শুনিতেন, রাজসভার লোক বাহবা দিত, মঞ্জরী ঘাটে আসিত- এবং অন্তঃপুরের বাতায়ন হইতে কখনো কখনো একটা ছায়া পড়িত, কখনো কখনো একটা নুপুর শুনা যাইত। NR এমন সময়ে দক্ষিণাত্য হইতে এক দিগ্বিজয়ী কবি শািলবিক্ৰীড়িত ছন্দে রাজার স্তবগান করিয়া রাজসভায় আসিয়া দাড়াইলেন । তিনি স্বদেশ হইতে বাহির হইয়া পথিমধ্যে সমস্ত রাজকবিদিগকে পরান্ত করিয়া অবশেষে অমরপুরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। রাজা পরম সমাদরের সহিত কহিলেন, “এহি, এহি ।” কবি পুণ্ডরীক দম্ভভরে কহিলেন, “যুদ্ধং দেহি ।” রাজার মান রাখিতে হইবে, যুদ্ধ দিতে হইবে, কিন্তু কাব্যযুদ্ধ যে কিরূপ হইতে পারে শেখরের সে সম্বন্ধে ভালোরূপ ধারণা ছিল না । তিনি অত্যন্ত চিন্তিত ও শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন । রাত্রে নিদ্রা হইল না। যশস্বী পুণ্ডৱীকের দীর্ঘ বলিষ্ঠ দেহ, সুতীক্ষ বক্র নাসা এবং দৰ্পেদ্ধত উন্নত মস্তক দিগ্বিদিকে অঙ্কিত দেখিতে লাগিলেন । প্ৰাতঃকালে কম্পিতহাদয় কবি রণক্ষেত্রে আসিয়া প্রবেশ করিলেন। প্রত্যুষ হইতে সভাতল লোকে পরিপূর্ণ হইয়া গেছে, কলরবের সীমা নাই ; নগরে আর সমস্ত কাজকর্ম একেবারে বন্ধ। * করিলেন ; পুণ্ডৱীক প্রচণ্ড অবহেলাভরে নিতান্ত ইঙ্গিতামাত্ৰে নমস্কার ফিরাইয়া দিলেন এবং নিজের অনুবতী। ভক্তবৃন্দের দিকে চাহিয়া হাসিলেন। শেখর একবার অন্তঃপুরের বাতায়নের দিকে কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন- বুঝিতে পারিলেন, সেখান হইতে আজ শত শত কীেতুহলপূর্ণ কৃষ্ণতারকার ব্যগ্ৰদূষ্টি এই জনতার উপরে অজস্র নিপতিত হইতেছে। একবার একাগ্রভাবে চিত্তকে সেই উৰ্ব্বলোকে উৎক্ষিপ্ত করিয়া আপনার জয়লক্ষ্মীকে বন্দনা করিয়া আসিলেন, মনে মনে কহিলেন, “আমার যদি আজ জয় হয় তবে, হে দেবি, হে অপরাজিতা, তাহাতে তোমারই নামের সার্থকতা হইবে।” তুরী ভেরি বাজিয়া উঠিল। জয়ধ্বনি করিয়া সমাগত সকলে উঠিয়া দাড়াইল। শুক্লবসন রাজা সুলক্ষণ শরৎপ্ৰভাতের শুভ্ৰ মেঘরাশির ন্যায় ধীরগমনে সভায় প্রবেশ করিলেন এবং সিংহাসনে উঠিয়া পুণ্ডৱীক উঠিয়া সিংহাসনের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইলেন। বৃহৎ সভা স্তব্ধ হইয়া গেল। বক্ষ বিস্ফারিত করিয়া গ্ৰীবা ঈষৎ উৰ্ব্বে হেলাইয়া বিরাটমূর্তি পুণ্ডরীক গাষ্ঠীরস্বরে উদয়নারায়ণের স্তব পাঠ করিতে আরম্ভ করিলেন। কণ্ঠস্বর ঘরে ধরে না- বৃহৎ সভাগৃহের চারিদিকের ভিত্তিতে স্তম্ভে ছাদে সমুদ্রের তরঙ্গের মতো গভীর মন্দ্ৰে আঘাত প্ৰতিঘাত করিতে লাগিল, এবং কেবল সেই ধ্বনির বেগে সমস্ত জনমণ্ডলীর বক্ষকবাট থর থর করিয়া স্পাদিত হইয়া উঠিল। কত কৌশল, কত কারুকার্য, উদয়নারায়ণ । নামের কতরূপ ব্যাখ্যা, রাজার নামাক্ষরের কতদিক হইতে কতপ্রকার বিন্যাস, কত ছন্দ, কত যমক ৷ পুণ্ডৱীক যখন শেষ করিয়া বসিলেন, কিছুক্ষণের জন্য নিস্তব্ধ সভাগৃহ ঠাহার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি ও সহস্ৰ হৃদয়ের নির্বক বিস্ময়রাশিতে গম গম করিতে লাগিল। বহু দূরদেশ হইতে আগত পণ্ডিতগণ দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া উচ্ছসিত স্বরে ‘সাধু সাধু করিয়া উঠিলেন। তখন সিংহাসন হইতে রাজা একবার শেখরের মুখের দিকে চাহিলেন। শেখরও ভক্তি প্ৰণয় অভিমান এবং একপ্রকার সকরুণ সংকোচপূর্ণদৃষ্টি রাজার দিকে প্রেরণ করিল এবং ধীরে উঠিয়া দাড়াইল। রাম যখন