পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ООУ. রবীন্দ্র-রচনাবলী লোকরঞ্জনার্থে দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষা করিতে চাহিয়াছিলেন, তখন সীতা যেন এইরূপভাবে চাহিয়া এমটি করিয়া তাহার স্বামীর সিংহাসনের সম্মুখে দাড়াইয়াছিলেন। , কবির দৃষ্টি নীরবে রাজাকে জানাইল, “আমি তোমারই। তুমি যদি বিশ্বসমক্ষে আমাকে দাঁড় করাইয় পরীক্ষা করিতে চাও তো করে । কিন্তু-” তাহার পরে নয়ন নত করিলেন। পুণ্ডৱীক সিংহের মতো দাড়াইয়াছিল, শেখর চারি দিকে ব্যাধবেষ্টিত হরিণের মতো দাঁড়াটুর্ল। তরু, যুবক, রমণীর ন্যায় লজ্জা এবং স্নেহ-কোমল মুখ, পাণ্ডুবৰ্ণ কপোল, শরীরাংশ নিতান্ত স্বল্প, দেখিলে মনে হ ভাবের স্পর্শমাত্রেই সমস্ত দেহ যেন বীণার তারের মতো কঁপিয়া বাজিয়া উঠিবে। শেখর মুখ না তুলিয়া প্রথমে অতি মৃদুস্বরে আরম্ভ করিলেন। প্রথম একটা শ্লোক বােধ হয় কেহ ভালে করিয়া শুনিতে পাইল না। তাহার পরে ক্রমে ক্রমে মুখ তুলিলেন- যেখানে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন সেখা হইতে যেন সমস্ত জনতা এবং রাজসভার পাষাণপ্রাচীর বিগলিত হইয়া বহুদূরবতী অতীতের মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া গেল। সুমিষ্ট পরিষ্কার কণ্ঠস্বর কঁাপিতে কঁাপিতে উজ্জ্বল অগ্নিশিখর ন্যায় উর্ধে উঠতে লাগিল প্রথমে রাজার চন্দ্ৰবংশীয় আদিপুরুষের কথা আরম্ভ করিলেন। ক্রমে ক্ৰমে কত যুদ্ধবিগ্ৰহ, শৌর্যবীয় যজ্ঞদান, কত মহদানুষ্ঠানের মধ্য দিয়া তাহার রাজকাহিনীকে বর্তমান কালের মধ্যে উপনীত করিলেন অবশেষে সেই দূরস্মৃতিবদ্ধ দৃষ্টিকে ফিরাইয়া আনিয়া রাজার মুখের উপর স্থাপিত করিলেন এবং রাজ্যে সমস্ত প্রজাহদায়ের একটা বৃহৎ অব্যক্ত গ্ৰীতিকে ভাষায় ছন্দে মূর্তিমান করিয়া সভার মাঝখানে দাঁড় করাই দিলেন- যেন দূরদূরান্ত হইতে শতসহস্র প্রজার হৃদয়স্রোত ছুটিয়া আসিয়া রােজপিতামহদিগের এ অতিপুরাতন প্ৰসাদকে মহাসংগীতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল— ইহার প্রত্যেক ইষ্টককে যেন তাহারা স্পী করিল, আলিঙ্গন করিল, চুম্বন করিল, উৰ্ব্বে অন্তঃপুরের বাতায়নসম্মুখে উখিত হইয়া রাজলক্ষ্মীস্বরূপ রাজাকে এবং রাজার সিংহাসনকে মহামহােল্লাসে শতশতবার প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল । অবশেষে বলিলে, “মহারাজ, বাক্যতে হার মানিতে পারি, কিন্তু ভক্তিতে কে হারাইবে।” এই বলিয়া কম্পিতীদেহে বসিয় পড়িলেন। তখন অশ্রুজলে অভিষিক্ত প্ৰজাগণ জয় জয় রবে আকাশ কঁপাইতে লাগিল। সাধারণ জনমণ্ডলীর এই উন্মত্ততাকে ধিক্কারপূর্ণ হাস্যের দ্বারা অবজ্ঞা করিয়া পুণ্ডৱীক আবার উঠি দাঁড়াইলেন। দৃপ্তগর্জনে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাক্যের চেয়ে শ্ৰেষ্ঠ কে।” সকলে এক মুহুর্তে স্তব্ধ হইয়া গেল তখন তিনি নানা ছন্দে অদ্ভুত পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিয়া বেদ বেদান্ত আগম নিগম হইতে প্রমাণ করি লাগিলেন- বিশ্বের মধ্যে বাক্যই সর্বশ্রেষ্ঠ । বাক্যই সত্য, বাক্যই ব্ৰহ্ম। ব্ৰহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর বাক্যের বা অতএব বাক্য তঁহাদের অপেক্ষা বড়ো। ব্ৰহ্মা চারিমুখে বাক্যকে শেষ করিতে পারিতেছেন না- পঞ্চান পাঁচমুখে বাক্যের অন্ত না পাইয়া অবশেষে নীরবে ধ্যান্যপরায়ণ হইয়া বাক্য খুঁজতেছেন। এমনি করিয়া পণ্ডিত্যের উপর পাণ্ডিত্য এবং শাস্ত্রের উপর শাস্ত্ৰ চাপাইয়া বাক্যের জন্য একটা অভ্ৰভে সিংহাসন নির্মাণ করিয়া বাক্যকে মর্ত্যলোক এবং সুরলোকের মস্তকের উপর বসাইয়া দিলেন এবং পুনর্ব বজনিনাদে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাক্যের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কে ৷” দর্পভরে চতুর্দিকে নিরীক্ষণ করিলেন ; যখন কেহ কোনো উত্তর দিল না। তখন ধীরে ধীরে আসন গ্ৰহ করিলেন। পণ্ডিতগণ সাধু সাধু ‘ধন্য ধন্য করিতে লাগিল-রাজা বিস্মিত হইয়া রহিলেন এবং কবি শেখ এই বিপুল পণ্ডিত্যের নিকট আপনাকে ক্ষুদ্র মনে করিলেন। আজিকার মতো সভাভঙ্গ হইল। VO) পরদিন শেখর আসিয়া গান আরম্ভ করিয়া দিলেন-বৃন্দাবনে প্রথম বাঁশি বাজিয়াছে, তখনো গোপিনী জানে না কে বাজাইল, জানে না কোথায় বাজিতেছে। একবার মনে হইল দক্ষিণপবনে বাজিতেছে, একবা মনে হইল উত্তরে গিরিগোবর্ধনের শিখর হইতে ধ্বনি আসিতেছে ; মনে হইল, উদয়াচলের উপরে দাড়াই কে মিলনের জন্য আহবান করিতেছে ; মনে হইল, অন্তাচলের প্রান্তে বসিয়া কে বিরহশোকে কঁদিতেছে