পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१७ष्ट्र V8S সংবাদ পাইলাম, কাবুলিওয়ালার সহিত মিনির এই যে দ্বিতীয় সাক্ষাৎ তাঁহা নহে, ইতিমধ্যে সে প্রায় প্রত্যহ আসিয়া পেস্তাবাদাম ঘুষ দিয়া মিনির ক্ষুদ্র লুব্ধ হৃদয়টুকু অনেকটা অধিকার করিয়া লইয়াছে। দেখিলাম, এই দুটি বন্ধুর মধ্যে গুটিকতক বাঁধা কথা এবং ঠাট্ট প্রচলিত আছে- যথা, রহমতকে দেখিবামাত্র আমার কন্যা হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিত, “কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা, তোমার ও : निद्र छिद्र शै ।" রহমত একটা অনাবশ্যক চন্দ্ৰবিন্দু যোগ করিয়া হাসিতে হাসিতে উত্তর করিত, “হাতি।” অর্থাৎ তাহার ঝুলির ভিতরে যে একটা হান্তী আছে, এইটেই তাহার পরিহাসের সূক্ষ্ম মর্ম। খুব যে বেশি সূক্ষ্ম তাহা বলা যায় না, তথাপি এই পরিহাসে উভয়েই বেশ একটু কৌতুক অনুভব করিত— এবং শরৎকালের প্রভাতে একটি বয়স্ক এবং একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর সরল হাস্য দেখিয়া আমারও বেশ लां5िोऊ । উহাদের মধ্যে আরো-একটা কথা প্রচলিত ছিল। রহমত মিনিকে বলিত, “খোষী, তেমি সসুরবাড়ি কখুনু যাবে না ।” বাঙালির ঘরের মেয়ে আজন্মকাল 'শ্বশুরবাড়ি" শব্দটার সহিত পরিচিত, কিন্তু আমরা কিছু একেলে ধরনের লোক হওয়াতে শিশু মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে সজ্ঞান করিয়া তোলা হয় নাই। এইজন্য রহমতের অনুরোধটা সে পরিষ্কার বুঝিতে পারিত না, অথচ কথাটার একটা-কোনাে জবাব না দিয়া চুপ করিয়া থাকা নিতান্ত তাহার স্বভাববিরুদ্ধ, সে উলটিয়া জিজ্ঞাসা করিত, “তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে ?” রহমত কাল্পনিক শ্বশুরের প্রতি প্ৰকাণ্ড মোটা মুষ্টি আস্ফালন করিয়া রলিত, “হামি সসুরকে মারবে।” শুনিয়া মিনি শ্বশুর নামক কোনো-এক অপরিচিত জীবের দুরবস্থা কল্পনা করিয়া অত্যন্ত হাসিত । এখন শুত্র শরৎকাল। প্রাচীনকালে এই সময়েই রাজারা দিগবিজয়ে বাহির হইতেন। আমি কলিকাতা ছাড়িয়া কখনো কোথাও যাই নাই, কিন্তু সেইজন্যই আমার মনটা পৃথিবীময় ঘুরিয়া বেড়ায়। আমি যেন আমার ঘরের কোণে চিরপ্রবাসী, বাহিরের পৃথিবীর জন্য আমার সর্বদা মন কেমন করে। একটা বিদেশের নাম শুনিলেই অমনি আমার চিত্ত ছুটয়া যায়, তেমনি বিদেশী লোক দেখিলেই অমনি নদী পর্বত অরণ্যের স্বাকী কূটলৈ দৃশ নেউল হয় এবং এটা উল্লশপূৰ্ণখনি উচ্চত্রর তৎকালত চল্লি এদিকে আবার আমি এমনি উদ্ভিজ্জপ্রকৃতি যে, আমার কোণটুকু ছাড়িয়া একবার বাহির হইতে গেলে মাথায় বজাঘাত হয়। এইজন্য সকালবেলায় আমার ছোটাে ঘরে টেবিলের সামনে বসিয়া এই কাবুলের সঙ্গে গল্প করিয়া আমার অনেকটা ভ্রমণের কাজ হইত। দুইধারে বন্ধুর দুৰ্গম দগ্ধ রক্তবর্ণ উচ্চ গিরিশ্রণী, মধ্যে সংকীর্ণ মরুপথ, বােঝাইকরা উষ্ট্রের শ্রেণী চলিয়ছে; পাগড়িপরা বণিক ও পথিকেরা কেহ বা উটের পরে, কেহ বা পদব্রজে, কাহারও হাতে বর্শা, কাহারও হাতে সেকেলে চকমকি-ঠোকা বন্দুক- কাবুল মেঘমন্দ্রস্বরে ভাঙা বাংলায় স্বদেশের গল্প করিত, আর এই ছবি আমার চােখের সন্মুখ দিয়া চলিয়া যাইত। মিনির মা অত্যন্ত শঙ্কিত স্বভাবের লোক। রাস্তায় একটা শব্দ শুনিলেই তাহার মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত মাতাল আমাদের বাড়িটাই বিশেষ লক্ষ্য করিয়া চুটিয়া আসিতেছে। এই পৃথিবীটা যে সর্বত্রই চোর ডাকাত মাতাল সাপ বাঘ ম্যালেরিয়া ওঁয়াপােকা আরসোলা এবং গোরার দ্বারা পরিপূর্ণ এতদিন (খুব বেশি দিন নহৈ) পৃথিবীতে বাস করিয়াও সে বিভীষিকা তঁহার মন হইতে দূর হইয়া যায় নাই। রহমত কাবুলিওয়ালা সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ নিঃসংশয় ছিলেন না। তাহার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখিবার জন্য