পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OBO রবীন্দ্র-রচনাবলী উদার এবং অতলস্পর্শ গভীর- অনেকটা স্বচ্ছ আকাশের মতো, উদয়ন্ত এবং ছায়ালোকের নিস্তব্ধ রঙ্গভূমি। এই বাক্যহীন মনুয্যের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির মতো একটা বিজন মহত্ব আছে। এইজন্য সাধারণ বালকবালিকারা তাহাকে একপ্রকার ভয় করিত, তাহার সহিত খেলা করিত না । সে নির্জন দ্বিপ্রহরের মতো শব্দহীন এবং সঙ্গীহীন । । R গ্রামের নাম চন্তীপুর। নদীটি বাংলাদেশের একটি ছােটাে নদী, গৃহস্থঘরের মেয়েটির মতো ; বহুদূর পর্যন্ত তাহার প্রসর নহে; নিরলসা তষী নদীটি আপন কূল রক্ষা করিয়া কাজ করিয়া যায়; দুই ধারের গ্রামের সকলেরই সঙ্গে তাহার যেন একটানা-একটা সম্পর্ক আছে। দুই ধরে লোকালয় এবং তরুচ্ছায়াঘন । উচ্চতট ; নিম্নতল দিয়া গ্রামলক্ষ্মী স্রোতস্বিনী আত্মবিস্মৃত দ্রুতপদক্ষেপে প্রফুল্লাহৃদয়ে আপনার অসংখ্য । কল্যাণকার্যে চলিয়াছে। বাণীকণ্ঠের ঘর নদীর একেবারে উপরেই। তাহার ব্যাখ্যারির বেড়া, আটচালা, গোয়ালঘর, টেকিশালা, খড়ের স্তৃপ, তেঁতুলতলা, আম কঁঠাল এবং কলার বাগান নীেকাবাহীমাত্রেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই গাৰ্হস্থ্য সচ্ছলতার মধ্যে বোবা মেয়েটি কাহারও নজরে পড়ে কি না জানি না, কিন্তু কাজকর্মে যখনই অবসর পায় তখনই সে এই নদীতীরে আসিয়া বসে। প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কলধ্বনি, চলাফেরা-আন্দোলন-কম্পনের সহিত এক হইয়া, সমুদ্রের তরঙ্গরাশির ন্যায়, বালিকার চিরনিস্তব্ধ হৃদয়-উপকূলের নিকট আসিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতি, ইহাও বােবার ভাষা- বড়ো বড়ো চক্ষুপল্লববিশিষ্ট সুভার যে-ভাষা তাহারই একটা বিশ্বব্যাপী বিস্তার ; ঝিল্লিরবপূর্ণ তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্ৰলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত, ভঙ্গী, সংগীত, ক্ৰন্দন এবং দীর্ঘনিশ্বাস। এবং মধ্যাহ্নে যখন মাঝিরা জেলেরা খাইতে যাইত, গৃহস্থেরা ঘুমাইত, পাখিরা ডাকিত না, খেয়া নীেকা বন্ধ থাকিত, সজন জগৎ সমস্ত কাজকর্মের মাঝখানে সহসা থামিয়া গিয়া ভয়ানক বিজন মূর্তি ধারণ করিত, তখন রুদ্র মহাকাশের তলে কেবল একটি বােবা প্রকৃতি এবং একটি বােবা মেয়ে মুখামুখি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত- একজন সুবিত্তীর্ণ রৌদ্রে আর-একজন ক্ষুদ্র তরুচ্ছায়ায়। সুভার যে গুটিকতক অন্তরঙ্গ বন্ধুর দল ছিল না, তাহা নহে। গােয়ালের দুটি গাভী, তাহাদের নাম সর্বশী ও পঙ্গুলি। সে নাম বালিকার মুখে তাহারা কখনো শুনে নাই, কিন্তু তাহার পদশব্দ তাহারা চিনিত— তাহার কথাহীন একটা করুণ সুর ছিল, তাহার মর্মাতাহারা ভাষার অপেক্ষা সহজে বুঝিত। সুভা কখন তাহদের আদর করিতেছে, কখন ভৎসনা করিতেছে, কখন মিনতি করিতেছে, তাহা তাহারা মানুষের অপেক্ষা ভালো বুঝিতে পারিত। - সুভা গোয়ালে ঢুকিয়া দুই বাহুর দ্বারা সর্বশীর গ্ৰীবা বেষ্টন করিয়া তাহার কানের কাছে আপনার গণ্ডদেশ ঘর্ষণ করিত এবং পাঙ্গুলি স্নিগ্ধদৃষ্টিতে তাহার প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া তাহার গা চাটিত। বালিকা দিনের মধ্যে নিয়মিত তিনবার করিয়া গােয়ালঘরে যাইত, তাহা ছাড়া অনিয়মিত আগমনও ছিল; গৃহে যেদিন কোনাে কঠিন কথা শুনিত, সেদিন সে অসময়ে তাহার এই মূক বন্ধু দুটির কাছে আসিত-তাহার সহিষ্ণুতাপরিপূর্ণ বিষ্যদশান্ত দৃষ্টিপাত হইতে তাহারা কী একটা অন্ধ অনুমানশক্তির দ্বারা বালিকার মর্মবেদনা যেন বুঝিতে পরিত, এবং সুভার গা ধেধিয়া আসিয়া অল্পে অল্পে তাহার বাহুতে শিং ঘষিয়া ঘষিয়া তাহাকে নির্বক ব্যাকুলতার সহিত সত্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিত। ইহারা ছাড়া ছাগল এবং বিড়ালশাষকও ছিল, কিন্তু তাঁহাদের সহিত সুভার এরূপ সমকক্ষভাবের মৈত্রী ছিল না, তথাপি তাহারা যথেষ্ট আনুগত্য প্রকাশ করিত। বিড়ালশিশুটি দিনে এবং রাত্রে যখন তখন সুভার