পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७४२ Վ. রবীন্দ্র-রচনাবলী গভীর পূর্ণিমারাত্রে সে এক-একদিন ধীরে শয়নগৃহের দ্বার খুলিয়া ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়াইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখে, পূর্ণিমা-প্রকৃতিও সুভার মতো একাকিনী সুপ্ত জগতের উপর জুগিয়া বসিয়া- যৌবনের রহস্যে পুলকে বিষাদে অসীম নির্জনতার একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত, এমনকি, তাহা অতিক্রম করিয়াও থমথম করিতেছে, একটি কথা কহিতে পারিতেছে না। এই নিন্তব্ধ ব্যাকুল প্রকৃতির প্রান্তে একটি নিস্তব্ধ ব্যাকুল বালিকা দাঁড়াইয়া। এদিকে কন্যাভারগ্রস্ত পিতামাতা চিন্তিত হইয়া উঠিয়াছেন। লোকেও নিন্দা আরম্ভ করিয়াছে। এমনকি, একঘরে করিবে এমন জনরবও শুনা যায়। বাণীকণ্ঠের সচ্ছল অবস্থা, দুইবেলাই মাছভাত খায়, এজন্য তাহার শত্রু ছিল। স্ত্রীপুরুষে বিস্তর পরামর্শ হইল। কিছুদিনের মতো বাণী বিদেশে গেল। অবশেষে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “চলো, কলিকাতায় চলো।” বিদেশীযাত্রার উদযোগ হইতে লাগিল। কুয়াশািঢাকা প্রভাতের মতো সুভার সমস্ত হৃদয় অশ্রুবাম্পে একেবারে ভরিয়া গেল। একটা অনির্দিষ্ট আশঙ্কবেশে সে কিছুদিন হইতে ক্ৰমাগত নির্বক জন্তুর মতো তাহার বাপমায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিত- ডাগর চক্ষু মেলিয়া তঁহাদের মুখের দিকে চাহিয়া কী একটা বুঝিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু ঠাহারা কিছু বুঝাইয়া বলতেন না। : ইতিমধ্যে একদিন অপরান্তে জলে ছিপ ফেলিয়া প্ৰতাপ হাসিয়া কহিল, “কী রে, সু, তোর নাকি বর পাওয়া গেছে, তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস ? দেখিস, আমাদের ভুলিস নে।” বলিয়া আবার মাছের দিকে মনোযোগ করিল। মৰ্মবিদ্ধ হরিণী ব্যাধের দিকে যেমন করিয়া তাকায়, নীরবে বলিতে থাকে ‘আমি তােমার কাছে কী দােষ করিয়াছিলাম, সুভা তেমনি করিয়া প্রতাপের দিকে চাহিল ; সেদিন গাছের তলায় আর বসিল না ; বাণীকণ্ঠ চাহিয়া কঁদিতে লাগিল। অবশেষে তাহাকে সাস্তুনা দিতে গিয়া বাণীকণ্ঠের শুষ্ক কপোলে অশ্রু গড়াইয়া পডিল । । কাল কলিকাতায় যাইবার দিন স্থির হইয়াছে। সুভা গোয়ালঘরে তাহার বাল্যাসখীদের কাছে বিদায় লইতে গেল, তাহাদিগকে স্বহস্তে খাওয়াইয়া, গলা ধরিয়া একবার দুই চােখে যত পারে কথা ভরিয়া তাঁহাদের মুখের দিকে চাহিল— দুই নেত্রপল্লব হইতে টপ টপ করিয়া অশ্রুজল পড়তে লাগিল। সেদিন শুক্লাদ্বাদশীর রাত্রি। সুভা শয়নগৃহ হইতে বাহির হইয় তাহার সেই চিরপরিচিত নদীতটে শম্পশয্যায় লুটাইয়া পড়িল- যেন ধারণীকে, এই প্রকাণ্ড মূক মানবমাতাকে দুই বাহুতে ধরিয়া বলিতে চাহে, “তুমি আমাকে যাইতে দিয়ে না। মা, আমার মতো দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখে।” কলিকাতার এক বাসায় সুভার মা একদিন সুভাকে খুব করিয়া সাজাইয়া দিলেন। আঁটিয়া চুল বাধিয়া খোপায় জরির ফিতা দিয়া, অলংকারে আচ্ছন্ন করিয়া তাহার স্বাভাবিক শ্ৰী যথাসাধ্য বিলুপ্ত করিয়া দিলেন। সুভার দুই চক্ষু দিয়া অশ্রু পড়িতেছে, পাছে চােখ ফুলিয়া খারাপ দেখিতে হয়, এজন্য তাহার মাতা তাহাকে BD BDDB DBBBBS DD BBLBD DDB BDD DDSS বন্ধু-সঙ্গে বর স্বয়ং কনে দেখিতে আসিলেন- কন্যার মা-বাপ চিন্তিত, শঙ্কিত, শশব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, যেন দেবতা স্বয়ং নিজের বলির পশু বাছিয়া লইতে আসিয়াছেন। মা নেপথ্য হইতে বিস্তর তর্জন গর্জন শাসন করিয়া বালিকার অশ্রুস্রোত দ্বিগুণ বাড়াইয়া পরীক্ষকের সম্মুখে পঠাইলেন। পরীক্ষক অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া বললেন, “মন্দ নহে।” বিশেষত, বালিকার ক্ৰন্দন দেখিয়া বুঝিলেন, ইহার হৃদয় আছে এবং হিসাব করিয়া দেখিলেন, যে-হৃদয় আজ বাপ-মায়ের বিচ্ছেদসম্ভাবনায় ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে সেই হৃদয় আজ বাদে কাল আমারই ব্যবহারে লাগিতে পরিবে। শুক্তির মুক্তর ন্যায় বালিকার অশ্রুজল কেবল বালিকার মূল্য বাড়াইয়া দিল, তাহার হইয়া আর-কোনো কথা বলিল না । .