পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ VVS তার টানিয়া বঁধিলেও টিলা হইয়া নামিয়া যায়- সে সুর আর কিছুতেই বাহির হয় না। গ্রামের লোকেরা বিস্তর আনন্দ প্রকাশ করিল। তাহারা একটা ভোজের জন্য শশিভূষণকে গিয়া ধরিল। শশিভূষণ রাধামুকুন্দকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী বল, ভাই ।” রাধামুকুন্দ বলিলেন, “অবশ্য, শুভদিনে আনন্দ করিতে হইবে বৈকি।” ህ* গ্রামে এমন ভোজ বহুকাল হয় নাই। গ্রামের ছােটােবড়ো সকলেই খাইয়া গেল। ব্ৰাহ্মণের দক্ষিণা এবং দুঃখীকাঙালগণ পয়সা ও কাপড় পাইয়া আশীৰ্বাদ করিয়া চলিয়া গেল। শীতের আরম্ভে গ্রামে তখন সময়টা খারাপ ছিল, তাহার উপরে শশিভূষণ পরিবেশনাদি বিবিধ কার্যে তিন-চারিদিন বিস্তর পরিশ্রম এবং অনিয়ম করিয়াছিলেন, তাহার ভগ্ন শরীরে আর সহিল না - তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িলেন। অন্যান্য দুরূহ উপসর্গের সহিত কম্প দিয়া জ্বর আসিল-বৈদ্য মাথা নাড়িয়া কহিল, “বড়ো শক্ত ব্যাধি।” রাত্রি দুই-তিন প্রহরের সময় রোগীর ঘর হইতে সকলকে বাহির করিয়া দিয়া রাধামুকুন্দ কহিলেন, “দাদা, তোমার অবর্তমানে বিষয়ের অংশ কাহাকে কিরূপ দিব, সেই উপদেশ দিয়া যাও।” শশিভূষণ কহিল, “ভাই, আমার কী আছে যে কাহাকে দিব।” রাধামুকুন্দ কহিলেন, “সবই তো তোমাের।” শশিভূষণ উত্তর দিলেন, “এককালে আমার ছিল, এখন আমার নহে।” রাধামুকুন্দ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। বসিয়া বসিয়া শয্যার এক অংশের চাদর দুই হাত দিয়া বার বার সমান করিয়া দিতে লাগিল। শশিভূষণের শ্বাসক্রিয়া কষ্টসাধ্য হইয়া উঠিল। রাধামুকুন্দ তখন শয্যাপ্রান্তে উঠিয়া বসিয়া রোগীর পা-দুটি ধরিয়া কহিল, “দাদা, আমি যে মহাপাতকের কাজ করিয়াছি, তাহা তোমাকে বলি, আর তো সময় নাই।” । শশিভূষণ কোনাে উত্তর করিলেন না— রাধামুকুন্দ বলিয়া গেলেন- সেই স্বাভাবিক শান্তভােব এবং ধীরে ধীরে কথা, কেবল মাঝে মাঝে এক-একটা দীর্ঘনিশ্বাস উঠতে লাগিল, “দাদা, আমার ভালো করিয়া বলিবার ক্ষমতা নাই। মনের যথার্থ যে-ভাব সে অন্তর্যমী জানেন, আর পৃথিবীতে যদি কেহ বুঝিতে পারে তো, হয়তো তুমি পরিবে। বালককাল হইতে তোমাতে আমাতে অন্তরে প্রভেদ ছিল না, কেবল বাহিরে প্রভেদ। কেবল এক প্রভেদ ছিল- তুমি ধনী, আমি দরিদ্র। যখন দেখিলাম। এই সামান্য সূত্রে তোমাতে আমাতে বিচ্ছেদের সম্ভাবনা ক্রমশই গুরুতর হইয়া উঠিতেছে, তখন আমিই সেই প্ৰভেদ লোপ করিয়াছিলাম। আমিই সদরখাজনা লুট করাইয়া তোমার সম্পত্তি নিলাম করাইয়াছিলাম।” শশিভূষণ তিলমাত্র বিস্ময়ের ভাব প্রকাশ না করিয়া ঈষৎ হাসিয়া মৃদুস্বরে রুদ্ধ উচ্চারণে কহিলেন, “ভাই, ভালোই করিয়াছিলে। কিন্তু যেজন্য এত করিলে তাহা কি সিদ্ধ হইল। কাছে কি রাখিতে পারিলে। দয়াময় হরি!” বলিয়া প্রশান্ত মৃদু হাস্যের উপরে দুই চক্ষু হইতে দুইবিন্দু অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। রাধামুকুন্দ তাহার দুই পায়ের নীচে মাথা রাখিয়া কহিল, “দাদা, মাপ করিলে তো ?” । শশিভূষণ তাহাকে কাছে ডাকিয়া তাহার হাত ধরিয়া কহিলেন, “ভাই, তবে শোনাে। এ কথা আমি প্রথম হইতেই জনিতাম। তুমি যাহাদের সহিত ষড়যন্ত্র করিয়াছিলে তাহারাই আমার নিকট প্রকাশ করিয়াছে। আমি তখন হইতে তোমাকে মাপ করিয়াছি।” রাধামুকুন্দ দুই করতলে লজ্জিত মুখ লুকাইয়া কঁদিতে লাগিল। অনেকক্ষণ পরে কহিল, “দাদা, মাপ যদি করিয়াছ, তবে তোমার এই সম্পত্তি তুমি গ্ৰহণ করো। রাগ করিয়া ফিরাইয়া দিয়ে না।” * শশিভূষণ উত্তর দিতে পারলেন না- তখন তাহার বাকুরোধ হইয়াছে — রাধামুকুন্দের মুখের দিকে অনিমেষে দৃষ্টি স্থাপিত করিয়া একবার দক্ষিণ হস্ত তুলিলেন। তাঁহাতে কী বুঝাইল বলিতে পারি না। বােধ করি। রাধামুকুন্দ বুঝিয়া থাকিবে। *፡ O S N&&