পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OS রবীন্দ্র-রচনাবলী সম্পাদক আমার স্ত্রী-বর্তমানে প্ৰভা সম্বন্ধে আমার কোনো চিন্তা ছিল না। তখন প্ৰভা অপেক্ষা প্রভার মাতাকে লইয়া কিছু অধিক ব্যস্ত ছিলাম। তখন কেবল প্রভার খেলাটুকু হাসিটুক দেখিয়া, তাহার আধো-আধো কথা শুনিয়া এবং আদরটুকু লইয়াই তৃপ্ত থাকিতাম ; যতক্ষণ ভালো লাগিতা নাড়াচাড়া করিতাম, কান্না আরম্ভ করিলেই তাহার মাির কোলে সমর্পণ করিয়া সত্বর অব্যাহতি লাইতাম। তাহাকে যে বহু চিন্তা ও চেষ্টায় মানুষ করিয়া তুলিতে হইবে, এ কথা আমার মনে আসে নাই । অবশেষে অকালে আমার স্ত্রীর মৃত্যু হইলে একদিন মায়ের কোল হইতে খসিয়া মেয়েটি আমার কোলের কাছে আসিয়া পড়িল, তাহাকে বুকে টানিয়া লইলাম। কিন্তু মাতৃহীনা দুহিতাকে দ্বিগুণ স্নেহে পালন করা আমার কর্তব্য এটা আমি বেশি চিন্তা করিয়াছিলাম, না, পত্নীহীন পিতাকে পরম যত্নে রক্ষা করা তাহার কর্তব্য এইটে সে বেশি অনুভব করিয়াছিল, আমি ঠিক বুঝিতে পারি না। কিন্তু ছয় বৎসর বয়স হইতেই সে গিন্নিপনা আরম্ভ করিয়াছিল। বেশ দেখা গেল ঐটুকু মেয়ে তাহার বাবার একমাত্র অভিভাবক হইবার চেষ্টা করিতেছে। আমি মনে মনে হাসিয়া তাহার হস্তে আত্মসমৰ্পণ করিলাম। দেখিলাম যতই আমি অকর্মণ্য অসহায় হই ততই তাহার লাগে ভালো ; দেখিলাম, আমি নিজে কাপড়টা ছাতাটা পাড়িয়া লইলে সে এমন ভাব ধারণ করে, যেন তাহার অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হইতেছে। বাবার মতো এতবড়ো পুতুল সে ইতিপূর্বে কখনো পায় নাই, এইজন্য বাবাকে খাওয়াইয়া পরাইয়া বিছানায় শুয়াইয়া সে সমস্ত দিন বড়ো আনন্দে আছে। কেবল ধারাপাত এবং পদ্যপাঠ প্রথমভাগ অধ্যাপনের সময় আমার পিতৃত্বকে কিঞ্চিৎ সচেতন করিয়া তুলিতে হইত। কিন্তু মাঝে মাঝে ভাবনা হইত মেয়েটিকে সৎপাত্রে বিবাহ দিতে হইলে অনেক অর্থের আবশ্যকআমার এত টাকা কোথায় । মেয়েকে তাে সাধ্যমত লেখাপড়া শিখাইতেছি কিন্তু একটা পরিপূর্ণ মূর্থের হাতে পড়িলে তাহার কী দশা হইবে। উপার্জনে মন দেওয়া গেল। গবর্মেন্ট আপিসে চাকরি করিবার বয়স গেছে, অন্য আপিসে প্রবেশ করিবারও ক্ষমতা নাই। অনেক ভাবিয়া বই লিখিতে লাগিলাম । বীশের নল ফুটা করিলে তাহাতে তেল রাখা যায় না, জল রাখা যায় না, তাহার ধারণাশক্তি মূলেই থাকে না ; তাহাতে সংসারের কোনো কাজই হয় না, কিন্তু ফু দিলে বিনা খরচে বঁশি বাজে ভালো। আমি স্থির। জানিতাম, সংসারের কোনো কাজেই যে-হতভাগ্যের বুদ্ধি খেলে না, সে নিশ্চয়ই ভালো বই লিখিবো। সেই সাহসে একখানা প্রহসন লিখিলাম, লোকে ভালো বলিল এবং রঙ্গভূমিতে অভিনয় হইয়া গেল। সহসা যশের আস্বাদ পাইয়া এমনি বিপদ হইল, প্রহসন আর কিছুতেই ছাড়িতে পারি না। সমস্ত দিন ব্যাকুল চিন্তান্বিত মুখে প্রহসন লিখিতে লাগিলাম। প্রভা আসিয়া আদর করিয়া স্নেহসহস্যে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, নাইতে যাবে না ?” আমি হুংকার দিয়া উঠিলাম, “এখন যা, এখন যা, এখন বিরক্ত করিস নে ৷” বালিকার মুখখানি বােধ করি একটি ফুৎকারে নির্বাপিত প্ৰদীপের মতো অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল ; কখন সে অভিমানবিশ্বফারিত-হৃদয়ে নীরবে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল আমি জানিতেও পারি নাই। দাসীকে তাড়াইয়া দিই, চাকরকে মারিতে যাই, ভিক্ষুক সুর করিয়া ভিক্ষা করিতে আসিলে তাহাকে লাঠি লইয়া তাড়া করি। পথপার্থেই আমার ঘর হওয়াতে যখন কোনো নিরীহ পান্থ জানলার বাহির হইতে আমাকে পথ জিজ্ঞাসা করে, আমি তাহাকে জাহান্নম নামক একটা অস্থানে যাইতে অনুরোধ করি। হায়, কেহই বুবিত না, আমি খুব একটা মজার প্রহসন লিখিতেছি। ! কিন্তু যতটা মজা এবং যতটা যশ হইতেছিল। সে পরিমাণে টাকা কিছুই হয় নাই। তখন টাকার কথা