পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ VVS কেবল নিবারণ নহে, হরসুন্দরীও একটা নূতন বেদনার পরিচয় পাইল। এ কিসের আকাঙক্ষা, এ কিসের দুঃসহ যন্ত্রণা। মন এখন যাহা চায়, কখনাে তাে তাহা চাহেও নাই, কখনাে তাে তাহা পায়ও নাই। যখন ভদ্রভাবে নিবারণ নিয়মিত আপিসে যাইত, যখন নিদ্রার পূর্বে কিয়াৎকালের জন্য গায়লার হিসাব, দ্রব্যের মহাৰ্ঘতা এবং লৌকিকতার কর্তব্য সম্বন্ধে আলোচনা চলিত, তখন তো এই অন্তর্বিািপ্লবের কোনাে সূত্রপািতমাত্র ছিল না। ভালোবাসিত বটে, কিন্তু তাহার তো কোনাে উজ্জ্বলতা, কোনো উত্তাপ ছিল না। সে ভালোবাসা অপ্ৰজ্বলিত ইন্ধনের মতো ছিল মাত্র । আজ তাহার মনে হইল, জীবনের সফলতা হইতে যেন চিরকাল কে তাহাকে বঞ্চিত করিয়া আসিয়াছে। তাহার হৃদয় যেন চিরদিন উপবাসী হইয়া আছে। তাহার এই নারীজীবন বড়ো দারিদ্র্যেই কাটিয়াছে। সে কেবল হাটবাজার পানমসলা তরিতরকারির ঝঞ্জাট লইয়াই সাতাশটা অমূল্য বৎসর দাসীবৃত্তি করিয়া কটাইল, আর আজ জীবনের মধ্যপথে আসিয়া দেখিল তাঁহারই শয়নকক্ষের পার্থে এক গোপন মহামহৈশ্বৰ্যভাণ্ডারের কুলুপ খুলিয়া একটি ক্ষুদ্র বালিকা একেবারে রাজরাজেশ্বরী হইয়া বসিল । নারী দাসী বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে নারী রানীও বটে। কিন্তু ভাগাভাগি করিয়া একজন নারী হইল দাসী, আর একজন নারী হইল রানী ; তাহাতে দাসীর গীেরব গেল, রানীর সুখ রহিল না। কারণ, শৈলবালাও নারী-জীবনের যথার্থ সুখের স্বাদ পাইল না। এত অবিশ্রাম আব্দর পাইল যে, ভালোবাসিবার আর মুহুর্ত অবসর রহিল না। সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হইয়া, সমুদ্রের মধ্যে আত্মবিসর্জন করিয়া বােধ করি নদীর একটি মহৎ চরিতার্থতা আছে, কিন্তু সমূদ্র যদি জোয়ারের টানে আকৃষ্ট হইয়া ক্ৰমাগতই নদীর উন্মুখীন হইয়া রহে, তবে নদী কেবল নিজের মধ্যেই নিজে ক্ষীত হইতে থাকে। সংসার তাহার সমস্ত আদর সোহাগ লইয়া দিবারাত্রি শৈলবালার দিকে অগ্রসর হইয়া রহিল, তাহাতে শৈলবালার আত্মােদর অতিশয় উভুঙ্গ হইয়া উঠিতে লাগিল, সংসারের প্রতি তাহার ভালোবাসা পড়িতে পাইল না। সে জানিল, আমার জন্যই সমস্ত এবং আমি কাহার জন্যও নাহি। এ অবস্থায় যথেষ্ট অহংকার আছে কিন্তু পরিতৃপ্তি কিছুই নাই। চতুর্থ পরিচ্ছেদ একদিন ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছে। এমনি অন্ধকার করিয়াছে যে, ঘরের মধ্যে কাজকর্ম করা অসাধ্য। বাহিরে বুপ ঝুপ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে। কুলগাছের তলায় লতাগুলোর জঙ্গল জলে প্রায় নিমগ্ন হইয়া গিয়াছে এবং প্রাচীরের পার্শ্ববতী নালা দিয়া ঘোলা জলস্রোত কলকল শব্দে বহিয়া চলিয়াছে। হরসুন্দরী আপনার নূতন শয়নগৃহের নির্জন অন্ধকারে জানলার কাছে চুপ করিয়া বসিয়া আছে। এমন সময় নিবারণ চোরের মতো ধীরে ধীরে দ্বারের কাছে প্রবেশ করিল, ফিরিয়া যাইবে কি অগ্রসর হইবে ভাবিয়া পাইল না। হরসুন্দরী তাহা লক্ষ্য করিল। কিন্তু একটি কথাও কহিল না। : তখন নিবারণ হঠাৎ একেবারে তীরের মতো হরসুন্দরীর পার্থে গিয়া এক নিশ্বাসে বলিয়া ফেলিল, “গোটকতক গহনার আবশ্যক হইয়াছে। জািন তো অনেকগুলো দেনা হইয়া পড়িয়াছে, পাওনাদার বড়োই অপমান করিতেছে- কিছু বন্ধক রাখিতে হইবে- শীঘ্রই ছাড়াইয়া লইতে পারিব।” হরসুন্দরী কোনো উত্তর দিল না, নিবারণ চােরের মতো দাড়াইয়া রহিল। অবশেষে পুনশ্চ কহিল, “তবে কি আজ হইবে না ।” ঘরে প্রবেশ করাও যেমন শক্ত, ঘর হইতে অবিলম্বে বাহির হওয়াও তেমনি কঠিন। নিবারণ একটু এদিকে ওদিকে চাহিয়া ইতস্তত করিয়া বলিল, “তবে অন্যত্র চেষ্টা দেখি গে যাই”, বলিয়া প্ৰস্থান করিল। ঋণ কোথায় এবং কোথায় গহনা বন্ধক দিতে হইবে হরসুন্দরী তাহা সমস্তই বুঝিল। বুঝিল, নববধূ। পূর্বরাত্রে তাহার এই হতবুদ্ধি পােষা পুরুষটিকে অত্যন্ত ঝংকার দিয়া বলিয়াছিল, “দিদির সিন্দুকভরা গহনা, আর আমি বুঝি একখানি পরিতে পারি না।” ।