পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ ᏔᏬᏄᏕ তখন হরসুন্দরী মর্মান্তিক বিরক্তি ও ঘূণা-ভরে বলিয়া উঠিল, “এই কি তোমার ছলছুতা করিবার, সোহাগ দেখাইবার সময়। চলো।” বলিয়া স্বামীকে লইয়া ছােটােবউয়ের ঘরে প্রবেশ করিল। ছোটােবউ কিছু বুঝিল না। সে সকল কথাতেই বলিল, “সে আমি কী জানি।” । সংসারের কোনো চিন্তা যে তাহাকে কখনো ভাবিতে হইবে এমন কথা কি তাহার সহিত ছিল । সকলে আপনার ভাবনা ভাবিবে এবং সকলে মিলিয়া শৈলবালার আরাম চিন্তা করিবে- অকস্মাৎ ইহার ব্যতিক্রম হয়, এ কী ভয়ানক অন্যায় ! . তখন নিবারণ শৈলবালার পায়ে ধরিয়া কঁাদিয়া পড়িল । শৈলবালা কেবলই বলিল, “সে আমি জানি না । আমার জিনিস। আমি কেন দিব ।” নিবারণ দেখিল ঐ দুর্বল ক্ষুদ্র সুন্দর সুকুমারী বালিকাটি লোহার সিন্দুকের অপেক্ষাও কঠিন। হরসুন্দরী সংকটের সময় স্বামীর দুর্বলতা দেখিয়া ঘূণায় জর্জরিত হইয়া উঠিল। শৈলবালার চাবি বলপূর্বক কাড়িয়া লাইতে গেল। শৈলবালা তৎক্ষণাৎ চাবির গোছা প্রাচীর লঙ্ঘন করিয়া পুষ্করিণীর মধ্যে ফেলিয়া দিল। । হরসুন্দরী হতবুদ্ধি স্বামীকে কহিল, “তালা ভাঙিয়া ফেলো-না।” শৈলবালা প্রশান্তমুখে বলিল, “তাহা হইলে আমি গলায় দড়ি দিয়া মরিব।” নিবারণ কহিল, “আমি আর-একটা চেষ্টা দেখিতেছি?” বলিয়া এলোথোলো বেশে বাহির হইয়া গেল । নিবারণ দুই ঘণ্টার মধ্যেই পৈতৃক বাড়ি আড়াই হাজার টাকায় বিক্রয় করিয়া আসিল । বহুকষ্টে হাতে বেড়িটা বঁচিল, কিন্তু চাকরি গেল। স্থাবর-জঙ্গমের মধ্যে রহিল কেবল দুটিমাত্র স্ত্রী। তাহার মধ্যে ক্লেশকাতর বালিকা স্ত্রীট গর্ভবতী হইয়া নিতান্ত স্থাবর হইয়াই পড়িল । গলির মধ্যে একটি ছোটাে সঁ্যাতসেঁতে বাড়িতে এই ক্ষুদ্র পরিবার আশ্রয় গ্ৰহণ করিল। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ ছোটােবউয়ের অসন্তোষ এবং অসুখের আর শেষ নাই। সে কিছুতেই বুঝিতে চায় না। তাহার স্বামীর ক্ষমতা নাই। ক্ষমতা নাই যদি তো বিবাহ করিল কেন । 凝 উপরের তলায় কেবল দুটিমাত্র ঘর। একটি ঘরে নিবারণ ও শৈলবালার শয়নগৃহ। আর-একটি ঘরে হরসুন্দরী থাকে। শৈলবালা খুঁতখুঁত করিয়া বলে, “আমি দিনরাত্রি শোবার ঘরে কাটাইতে পারি না।” নিবারণ মিথ্যা আশ্বাস দিয়া বলিত, “আমি আর-একটা ভালো বাড়ির সন্ধানে আছি, শীঘ্ৰ বাড়ি বদল कलिव ।” শৈলবালা বলিত, “কেন, ঐ তো পাশে আর-একটা ঘর আছে।” শৈলবালা তাহার পূর্ব প্রতিবেশিনীদের দিকে কখনাে মুখ তুলিয়া চাহে নাই। নিবারণের বর্তমান দুরবস্থায় ব্যথিত হইয়া তাহারা একদিন দেখা করিতে আসিল ; শৈলবালা ঘরে খিল দিয়া বসিয়া রহিল, কিছুতেই দ্বার খুলিল না। তাহারা চলিয়া গেলে রাগিয়া,কঁদিয়া, উপবাসী থাকিয়া, হিস্টিরিয়া করিয়া পাড়া মাথায় করিল। এমনতরো উৎপাত প্ৰায় ঘটিতে লাগিল । অবশেষে শৈলবালার শারীরিক সংকটের অবস্থায় গুরুতর পীড়া হইল, এমনকি, গর্ভপাত হইবার উপক্রম হইল । নিবারণ হরসুন্দরীর দুই হাত ধরিয়া বলিল, “তুমি শৈলকে বীচাও।” হরসুন্দরী দিন নাই। রাত্রি নাই শৈলবালার সেবা করিতে লাগিল। তিলমাত্র ত্রুটি হইলে শৈল তাঁহাকে দুর্বাক্য বলিত, সে একটি উত্তর মাত্র করিত না। শৈল কিছুতেই সাগু খাইতে চাহিত না, বাটিসূদ্ধ ষ্টুড়িয়া ফেলিত, জ্বরের সময় কঁচা আমের অম্বল দিয়া ভাত খাইতে চাহিত। না পাইলে রাগিয়া কঁদিয়া অনৰ্থপতি করিত। হরসুন্দরী তাঁহাকে “লক্ষ্মী আমার", “বোন আমার”, “দিদি আমার” বলিয়া শিশুর মতো ভুলাইতে চেষ্টা করিত। কিন্তু শৈলবালা বঁচিল না। সংসারের সমস্ত সোহাগ আদর লইয়া পরম অসুখ ও অসন্তোষে বালিকার ক্ষুদ্র অসম্পূর্ণ ব্যর্থ জীবন নষ্ট হইয়া গেল।