পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ । etr. বয়স ; অবশ্য ইটের ভূপটা তেমন উল্লেখযোগ্য নহে, কিন্তু যে ব্যক্তি তাহার উপর বসিয়া ছিল সে এই শুষ্ক কঠিন আসনের প্রতিও একটি মনোরম শ্ৰী বিস্তার করিয়াছিল। হায়, এমন দৃশ্যের মধ্যে প্রথম পদক্ষেপমাত্রেই যে সমস্ত কবিত্ব প্রহসনে পরিণত হয় ইহা অপেক্ষা অদৃষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা আর কী হইতে পারে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ সেই ইষ্টকশিখর হইতে প্রবহমান হাস্যধ্বনি শুনিতে শুনিতে চাদরে ও ব্যাগে কাদা মাখিয়া গাছের ছায়া দিয়া অপূর্ব বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইল। অকস্মাৎ পুত্রের আগমনে তাহার বিধবা মাতা পুলকিত হইয়া উঠিলেন। তৎক্ষণাৎ ক্ষীর-দধি-রুইমাছের সন্ধানে দূরে নিকটে লোক দীেড়িল এবং পাড়াপ্রতিবেশীর মধ্যেও একটা আন্দােলন উপস্থিত হইল। আহারান্তে মা অপূৰ্বর বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপন করিলেন। অপূর্ব সেজন্য প্রস্তুত হইয়া ছিল। কারণ প্রস্তাব অনেক পূর্বেই ছিল, কিন্তু পুত্র নব্যাতন্ত্রের নূতন ধুয়া ধরিয়া জেদ করিয়া বসিয়া ছিল যে, বি. এ. পাস না করিয়া বিবাহ করিব না। এতকাল জননী সেইজন্য অপেক্ষা করিয়া ছিলেন, অতএব এখন আর কোনো ওজর করা মিথ্যা। অপূর্ব কহিল, “আগে পাস্ত্রী দেখা হউক, তাহার পর স্থির হইবে।” মা কহিলেন, “পাস্ত্রী দেখা হইয়াছে, সেজন্য তোকে ভাবিতে হইবে না ।” অপূর্ব ঐ ভাবনাটা নিজে ভাবিতে প্ৰস্তুত হইল এবং কহিল, “মেয়ে না দেখিয়া বিবাহ করিতে পারিব না।” মা ভাবিলেন, এমন সৃষ্টিছাড়া কথাও কখনাে শোনা যায় নাই, কিন্তু সম্মত হইলেন। সে রাত্রে অপূর্ব প্ৰদীপ নিবাইয়া বিছানায় শয়ন করিলে পর বর্ধনশীথের সমস্ত শব্দ এবং সমস্ত নিস্তব্ধতার পরপ্রান্ত হইতে বিজন বিনিদ্রা শয্যায় একটি উচ্ছসিত উচ্চ মধুর কণ্ঠের হাস্যধ্বনি তাহার কানে । আসিয়া ক্রমাগত বাজিতে লাগিল। মন নিজেকে কেবলই এই বলিয়া পীড়া দিতে লাগিল যে, সকালবেলাকার সেই পদস্থলেনটা যেন কোনো-একটা উপায়ে সংশোধন করিয়া লওয়া উচিত । বালিকা জানিল না যে, আমি অপূর্বকৃষ্ণ অনেক বিদ্যা উপার্জন করিয়াছি, কলিকাতায় বহুকাল যাপন করিয়া । আসিয়াছি, দৈবাৎ পিছলে পা দিয়া কাদায় পড়িয়া গেলেও আমি উপহাস্য উপেক্ষণীয় একজন যে-সে। গ্ৰাম্য যুবক নাহি। পরদিন অপূর্ব কনে দেখিতে যাইবে । অধিক দূরে নহে, পাড়াতেই তাঁহাদের বাড়ি। একটু বিশেষ যত্নপূর্বক সাজ করিল। ধুতি ও চাদর ছাড়িয়া সিস্কের চাপকন জোব্বা, মাথায় একটা গোলাকার পাগড়ি, এবং বানিশ-করা একজোড়া জুতা পায়ে দিয়া সিস্কের ছাতা হন্তে প্ৰাতঃকালে বাহির হইল । সম্ভাবিত শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণ করিবামাত্র মহাসমারোহ-সমাদরের ঘটা পড়িয়া গেল। অবশেষে যথাকলে কম্পিতহাদয় মেয়েটিকে ঝাড়িয়া মুছিয়া রঙ করিয়া খোপায় রাতো জড়াইয়া একখানি পাতলা । রঙিন কাপড়ে মুড়িয়া বরের সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করা হইল। সে এক কোণে নীরবে মাথা প্রায় হাঁটুর কাছে ঠেকাইয়া বসিয়া রহিল এবং এক প্রৌঢ়া দাসী তাঁহাকে সাহস দিবার জন্য পশ্চাতে উপস্থিত রহিল। কনের এক বালক ভাই তাঁহাদের পরিবারের মধ্যে এই এক নূতন অনধিকার-প্রবেশোদ্যত লোকটির পাগড়ি, ঘড়ির চেন এবং নবােদগত শ্মশ্ৰ একমনে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। অপূর্ব কিিয়ংকাল গীেফে তা দিয়া অবশেষে গভীরভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কী পড়া।” বসনভূষণাচ্ছন্ন লজ্জাস্তুপের নিকট হইতে তাহার কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। দুই-তিনবার প্রশ্ন এবং প্রৌঢ়া দাসীর নিকট হইতে পৃষ্ঠদেশে বিস্তর উৎসাহসজনক করতাড়নের পর বালিকা মৃদুস্বরে একনিশ্বাসে অত্যন্ত দ্রুত বলিয়া গেল, চারুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ, ব্যাকরণসার প্রথম ভাগ, ভূগোলবিবরণ, পাটিগণিত, ভারতবর্ষের ইতিহাস। এমন সময় বহির্দেশে একটা অশান্ত গতির ধুপ ধােপ শব্দ শোনা গেল এবং মুহুর্তের মধ্যে দৌড়িয়া হাঁপাইয়া পিঠের চুল দোলাইয়া মৃন্ময়ী ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। অপূর্বকৃষ্ণের প্রতি দৃকপাত না করিয়া একেবারে কনের ভাই রাখলের হাত ধরিয়া টানাটানি আরম্ভ করিয়া দিল। রাখাল তখন আপন পর্যবেক্ষণশক্তির চর্চায় একান্তমনে নিযুক্ত ছিল, সে কিছুতেই উঠিতে চাহিল না। দাসীটি তাহার সংযত কণ্ঠস্বরের মৃত্তা রক্ষার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া