পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

evt. রবীন্দ্র-রচনাবলী যথাসাধ্য তীব্রভাবে মৃন্ময়ীকে ভৎসনা করিতে লাগিল। অপূর্বকৃষ্ণ আপনার সমন্ত গভীৰ্য এবং গীেরব একত্র করিয়া পাগড়ি-পরা মস্তকে অভ্ৰভেদী হইয়া বসিয়া রহিল এবং পেটের কাছে ঘড়ির চেন নাড়িতে লাগিল । অবশেষে সঙ্গীটিকে কিছুতেই বিচলিত করিতে না পারিয়া তাহার পিঠে একটা সশব্দ চপেটাঘাত করিয়া এবং চট করিয়া কনের মাথার ঘোমটা টানিয়া খুলিয়া দিয়া ঝড়ের মতো মৃন্ময়ী ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। দাসীটি গুমরিয়া গর্জন করিতে লাগিল এবং ভগ্নীর অকস্মাৎ অবগুণ্ঠন মোচনে রাখাল খিল খিল শব্দে হাসিতে আরম্ভ করিল। নিজের পৃষ্ঠের প্রবল চপেটাঘাতটি সে অন্যায় প্রাপ্য মনে করিল না, কারণ, এরূপ দেনা-পাওনা তাহাদের মধ্যে সর্বদাই চলিতেছে। এমনকি, পূর্বে মৃন্ময়ীর চুল কঁাধ ছাড়াইয়া পিঠের মাঝামাঝি আসিয়া পড়িত ; রাখলেই একদিন হঠাৎ পশ্চাৎ হইতে আসিয়া তাহার কুঁটির মধ্যে কঁচি চালাইয়া দেয়। মৃন্ময়ী তখন অত্যন্ত রাগ করিয়া তাহার হাত হইতে কঁচিটি কড়িয়া লইয়া নিজের অবশিষ্ট পশ্চাতের চুল কঁ্যাচ কঁ্যাচ শব্দে নির্দয়ভাবে কাটিয়া ফেলিল, তাহার কেঁকড়া চুলের স্তবকগুলি শাখাচুত কালো আঙুরের ভূপের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ মাটিতে পড়িয়া গেল। উভয়ের মধ্যে এরূপ শাসনপ্রণালী প্রচলিত श्लिल । অতঃপর এই নীরব পরীক্ষাসভা আর অধিকক্ষণ স্থায়ী হইল না। পিণ্ডাকার কন্যাটি কোনােমতে পুনশ্চ দীর্ঘকার হইয়া দাসী সহকারে অন্তঃপুরে চলিয়া গেল। অপূর্ব পরম গভীরভাবে বিরল গুফরেখায় তা দিতে দিতে উঠিয়া ঘরের বাহিরে যাইতে উদ্যত হইল। দ্বারের নিকটে গিয়া দেখে, বার্নিশ করা নূতন জুতাজোড়াটি যেখানে ছিল সেখানে নাই, এবং কোথায় আছে তাহাও বহুচেষ্টায় অবধারণ করা গেল না । বাড়ির লোক সকলেই বিষম বিব্রত হইয়া উঠিল এবং অপরাধীর উদ্দেশে গালি ও ভৎসনা অজস্র বর্ষিত হইতে লাগিল। অনেক খোজ করিয়া অবশেষে অনন্যেপায় হইয়া বাড়ির কর্তার পুরাতন ছিন্ন চিলা চটিজোড়াটা পরিয়া প্যান্টলুন চাপকান পাগড়িসমেত সুসজ্জিত অপূর্বকৰ্দমাক্ত গ্ৰামপথে অত্যন্ত সাবধানে চলিতে লাগিল । পুষ্করিণীর ধারে নির্জন পথপ্রান্তে আবার হঠাৎ সেই উচ্চকণ্ঠের অজস্র হাস্যকলোচ্ছাস। যেন তরুপল্লবের মধ্য হইতে কৌতুকপ্রিয়া বনদেবী অপূৰ্বর ঐ অসংগত চটিজুতাজোড়ার দিকে চাহিয়া হঠাৎ আর হাসি ধারণ করিয়া রাখিতে পারিল না । অপূর্ব অপ্রতিভভাবে থমকিয়া দাড়াইয়া ইতস্তত নিরীক্ষণ করিতেছে এমন সময় ঘন বন হইতে বাহির হইয়া একটি নির্লজ্জ অপরাধিনী তাহার সম্মুখে নূতন জুতাজোড়াটি রাখিয়াই পলায়নােদ্যত হইল। অপূর্ব দ্রুতবেগে দুই হাত ধরিয়া তাহাকে বন্দী করিয়া ফেলিল। মৃন্ময়ী আঁকিয়া বঁকিয়া হাত ছাড়াইয়া পলাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না। কেঁকড়া চুলে বেষ্টিত তাহার পরিপুষ্ট সহাস্য দুষ্ট মুখখানির উপরে শাখান্তরালচুত সূৰ্যকিরণ আসিয়া পড়িল। রৌদ্রোজ্জ্বল নির্মল চঞ্চল নিঝরিণীর দিকে অবনত হইয়া কৌতুহলী পথিক যেমন নিবিষ্টদৃষ্টিতে তাহার তলদেশ দেখিতে থাকে, অপূর্ব তেমনি করিয়া গভীর গষ্ঠীর নেত্ৰে মৃন্ময়ীর উৰ্ব্বোৎক্ষিপ্ত মুখের উপর, তড়িত্তরল দুটি চক্ষুর মধ্যে চাহিয়া দেখিল এবং অত্যন্ত ধীরে ধীরে মুষ্টি শিথিল করিয়া যেন যথাকর্তব্য অসম্পন্ন রাখিয়া বন্দিনীকে ছাড়িয়া দিল। অপূর্ব যদি রাগ করিয়া মৃন্ময়ীকে ধরিয়া মারিত তাহা হইলে সে কিছুই আশ্চর্য হইত না, কিন্তু নির্জন পথের মধ্যে এই অপরূপ নীরব শান্তির সে কোনাে অর্থ বুঝিতে পারিল না। ’ নৃত্যময়ী প্রকৃতির নূপুরনিকণের ন্যায় চঞ্চল হাস্যধ্বনিট সমস্ত আকাশ ব্যাপিয়া বাজিতে লাগিল এবং চিন্তানিমগ্ন অপূর্বকৃষ্ণ অত্যন্ত ধীরপদক্ষেপে বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। " তৃতীয় পরিচ্ছেদ অপূর্ব সমস্তদিন নানা ছুতা করিয়া অন্তঃপুরে মাের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেল না। বাহিরে নিমন্ত্রণ ছিল, খাইয়া আসিল । অপূৰ্বর মতো এমন একজন কৃতবিদ্য গষ্ঠীর ভাবুক লোক একটি সামান্য অশিক্ষিতা বালিকার কাছে আপনার লুপ্ত গীেরব উদ্ধার করিবার, আপনার আন্তরিক মহাষ্মের পরিপূর্ণ পরিচয় দিবার