পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

外丽g觅 ob〉 তাহার পরদিন মৃন্ময়ী বাপের কােছ হইতে এক পত্র পাইল। তিনি তাহার প্রাণপ্ৰতিমা মৃন্ময়ীর বিবাহের সময় উপস্থিত থাকিতে পারেন নাই বলিয়া বিলাপ করিয়া নবদম্পতিকে অন্তরের আশীৰ্বাদ পঠাইয়াছেন। মৃন্ময়ী শাশুড়িকে গিয়া কহিল, “আমি বাবার কাছে যাব।” শাশুড়ি অকস্মাৎ এই অসম্ভব প্রার্থনায় তাহকে ভৎসনা করিয়া উঠিলেন, “কোথায় ওর বাপ থাকে তার ঠিকানা নেই, বলে বাবার কাছে যাব। অনাসৃষ্টি আবদার।” সেউত্তর না করিয়া চলিয়া গেল। আপনার ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া নিতান্ত হতাশ্বাস ব্যক্তি যেমন করিয়া দেবতার কাছে প্রার্থনা করে তেমনি করিয়া বলিতে লাগিল, “বাবা, আমাকে তুমি নিয়ে । যাও । এখানে আমার কেউ নেই। এখানে থাকলে আমি বঁচব না।” গভীর রাত্রে তাহার স্বামী নিদ্রিত হইলে ধীরে ধীরে দ্বার খুলিয়া মৃন্ময়ী গৃহের বাহির হইল। যদিও এক-একবার মেঘ করিয়া আসিতেছিল। তথাপি জ্যোৎস্নারাত্রে পথ দেখিবার মতো আলোক যথেষ্ট ছিল । বাপের কাছে যাইতে হইলে কােন পথ অবলম্বন করিতে হইবে মৃন্ময়ী তাহার কিছুই জ্বনিত না। কেবল তাহার মনের বিশ্বাস ছিল, যে-পথ দিয়া ডাকের পত্রবাহক রানারগণ চলে সেই পথ দিয়া পৃথিবীর সমস্ত ঠিকানায় যাওয়া যায়। মৃন্ময়ী সেই ডাকের পথ ধরিয়া চলিতে লাগিল। চলিতে চলিতে শরীর শ্ৰান্ত হইয়া আসিল, রাত্রিও প্রায় শেষ হইল। বনের মধ্যে যখন উসখুসি করিয়া অনিশ্চিত সুরে দুটাে একটা পাখি ডাকিবার উপক্ৰম করিতেছে অথচ নিঃসংশয়ে সময় নির্ণয় করিতে না পারিয়া ইতস্তত করিতেছে তখন মৃন্ময়ী পথের শেষে নদীর ধারে একটা বৃহৎ বাজারের মতো স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। অতঃপর কোনদিকে যাইতে হইবে ভাবিতেছে এমন সময় পরিচিত ঝমােঝম শব্দ শুনিতে পাইল। চিঠির থলে কঁধে করিয়া উর্ধ্বশ্বাসে ডাকের রানার আসিয়া উপস্থিত হইল। মৃন্ময়ী তাড়াতাড়ি তাহার কাছে গিয়া কাতর শ্ৰান্তস্বরে কহিল, “কুশীগঞ্জে আমি বাবার কাছে যােব, আমাকে তুমি সঙ্গে নিয়ে চলোনা।” সে কহিল, “কুশীগঞ্জ কোথায় আমি জানি নে ৷” এই বলিয়া ঘাটে বাধা ডাকনীেকার মার্কিকে জাগাইয়া দিয়া নীেকা ছাড়িয়া দিল । তাহার। দয়া করিবার বা প্রশ্ন করিবার সময় নাই। দেখিতে দেখিতে হাট এবং বাজার সজাগ হইয়া উঠিল। মৃন্ময়ী ঘাটে নামিয়া একজন মাঝিকে ডাকিয়া কহিল, “মাঝি, আমাকে কুশীগঞ্জে নিয়ে যাবে?” মাঝি তাহার উত্তর দিবার পূর্বেই পাশের নীেকা হইতে একজন বলিয়া উঠিল, “আরো কে ও ? মিনু মা, তুমি এখানে কোথা থেকে।” মৃন্ময়ী উচ্ছসিত ব্যগ্রতার সহিত বলিয়া উঠিল, “বনমালী, আমি কুশীগঞ্জে বাবার কাছে যােব, আমাকে তোর নীেকায় নিয়ে চল।” বনমালী তাহদের গ্রামের মাঝি ; সে এই উদ্ধৃঙ্খলপ্রকৃতি বালিকাটিকে বিলক্ষণ চিনিত, সে কহিল, “বাবার কাছে যাবে ? সে তো বেশ কথা। চলো, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।” মৃন্ময়ী নীেকায় উঠিল। মাঝি নীেকা ছাড়িয়া দিল। মেঘ করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। ভদ্রমাসের পূর্ণ নদী ফুলিয়া ফুলিয়া নীেক দােলাইতে লাগিল, মৃন্ময়ীর সমস্ত শরীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হইয়া আসিল; অঞ্চল পাতিয়া সে নীেকার মধ্যে শয়ন করিল এবং এই দুরন্ত বালিকা নদী-দােলায় প্রকৃতির স্নেহপালিত শান্ত শিশুটির মতাে । অকাতরে ঘুমাইতে লাগিল। জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, সে তাহার শ্বশুরবাড়িতে খাটে শুইয়া আছে। তাহাকে জাগ্ৰত দেখিয়া ঝি বকিতে আরম্ভ করিল। বির কণ্ঠস্বরে শাশুড়ি আসিয়া অত্যন্ত কঠিন কঠিন করিয়া বলিতে লাগিলেন। মৃন্ময়ী বিস্ফারিতনেত্রে নীরবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। অবশেষে তিনি যখন তাহার বাপের শিক্ষাদোষের উপর কটাক্ষ করিয়া বলিলেন, তখন মৃন্ময়ী দ্রুতপদে পাশের ঘরে প্রবেশ করিয়া ভিতর হইতে শিকল বন্ধ कशिां निन | অপূৰ্বলজ্জার মাথা খাইয়া মাকে আসিয়া বলিল, “মা, বউকে দুই-একদিনের জন্যে একবার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে দোষ কী ।” মা অপূর্বক নি ভূতো ন ভবিষ্যতি ভৎসনা করিতে লাগিলেন, এবং দেশে এত মেয়ে থাকিতে বাছিয়া বাছিয়া এই অস্থিদাহকারী দস্য-মেয়েকে ঘরে আনার জন্য তাহাকে যথেষ্ট গঞ্জনা করিলেন।