পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

tS রবীন্দ্র-রচনাবলী পঞ্চম পরিচ্ছেদ সেদিন সমস্তদিন বাহিরে ঝড়বৃষ্টি এবং ঘরের মধ্যেও অনুরূপ দুর্যোেগ চলিতে লাগিল। তাহার পরদিন গভীর রাত্রে অপূর্ব মৃন্ময়ীকে ধীরে ধীরে জাগ্ৰত করিয়া কহিল, “মৃন্ময়ী, তোমার বাবার কাছে যাবে ?” মৃন্ময়ী সবেগে অপূৰ্বর হাত চাপিয়া ধরিয়া সচকিিত হইয়া কহিল, “যাব।” অপূর্ব চুপিচুপি কহিল, “তবে এসো, আমরা দুজনে আন্তে আস্তে পালিয়ে যাই। আমি ঘাটে নীেকা ঠিক করে রেখেছি।” & মৃন্ময়ী অত্যন্ত সকৃতজ্ঞ হৃদয়ে একবার স্বামীর মুখের দিকে চাহিল। তাহার পর তাড়াতাড়ি উঠিয়া কাপড় ছাড়িয়া বাহির হইবার জন্য প্রস্তুত হইল। অপূর্ব তাহার মাতার চিন্তা দূর করিবার জন্য একখানি পত্র রাখিয়া দুইজনে বাহির হইল। " মৃন্ময়ী সেই অন্ধকার রাত্রে জনশূন্য নিন্তব্ধ নির্জন গ্ৰামপথে এই প্রথম স্বেচ্ছায় আন্তরিক নির্ভরের সহিত স্বামীর হাত ধরিল ; তাহার হৃদয়ের আনন্দ-উদবেগ সেই সুকোমল স্পর্শযোগে তাহার স্বামীর শিরার মধ্যে সঞ্চারিত হইতে লাগিল। : নীেক সেই রাত্রেই ছাড়িয়া দিল। অশান্ত হৰ্যোেচ্ছস সত্ত্বেও অনতিবিলম্বেই মৃন্ময়ী ঘুমাইয়া পড়িল । পরদিন কী মুক্তি, কী আনন্দ। দুইধারে কত গ্রাম বাজার শস্যক্ষেত্র বন, দুইধারে কত নীেক যাতায়াত করিতেছে। মৃন্ময়ী প্রত্যেক তুচ্ছ বিষয়ে স্বামীকে সহস্রবার করিয়া প্রশ্ন করিতে লাগিল। ঐ নীেকায় কী আছে, উহারা কোথা হইতে আসিয়াছে, এই জায়গার নাম কী, এমন সকল প্রশ্ন যাহার উত্তর অপূর্ব কোনাে কলেজের বহিতে পায় নাই এবং যাহা তাহা কলিকাতার অভিজ্ঞতায় কুলইয়া উঠে না। বন্ধুগণ শুনিয়া লজ্জিত হইবেন, অপূর্ব এই সকল প্রশ্নের প্রত্যেকটারই উত্তর করিয়াছিল এবং অধিকাংশ উত্তরের সহিত সত্যের ঐক্য হয় নাই। যথা, সে তিলের নীেকাকে তিসির নীেকা, পাচবেড়েকে রায়নগর এবং মুনসেফের আদালতকে জমিদারি কাছারি বলিতে কিছুমাত্র কুষ্ঠিত বােধ করে নাই। এবং এই সমস্ত ভ্রান্ত উত্তরে বিশ্বস্তহৃদয় প্রশ্নকারিণীর সন্তোষের তিলমাত্র ব্যাঘাত জন্মায় নাই। পরদিন সন্ধ্যাবেলায় নীেক কুশীগঞ্জে গিয়া পৌঁছিল। টিনের ঘরে একখানি ময়লা চোকা-কাচের লন্ঠনে তেলের বাতি জ্বালাইয়া ছোটাে ডেস্কের উপর একখানি চামড়ায় বাধা মস্ত খাতা রাখিয়া গা-খোলা ঈশানচন্দ্র টুলের উপর বসিয়া হিসাব লিখিতেছিলেন। এমন সময় নবদম্পতি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। মৃন্ময়ী ডাকিল, “বাবা।” সে ঘরে এমন কণ্ঠ ধ্বনি এমন করিয়া কখনো ধ্বনিত হয় নাই। ঈশানের চোখ দিয়া দরদর করিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল। সে কী বলিবে, কী করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না। তাহার মেয়ে এবং জামাই যেন সাম্রাজ্যের যুবরাজ এবং যুবরাজমহিষী; এই সমস্ত পাটের বস্তার মধ্যে তাহাদের উপযুক্ত সিংহাসন কেমন করিয়া নির্মিত হইতে পারে ইহাই যেন তাহার দিশহারা বুদ্ধি ঠিক করিয়া ऐछठेिठ १ोलि ना । তাহার পরে আহারের ব্যাপার- সেও এক চিন্তা। দরিদ্র কেরানি নিজ হস্তে ডাল ভাতে-ভাত পাক করিয়া খায়- আজ এই এমন আনন্দের দিনে সে কী করবে, কী খাওয়াইবে । মৃন্ময়ী কহিল, “বাবা, আজ আমরা সকলে মিলিয়া রাধিব ।” অপূর্ব এই প্রস্তাবে সাতিশয় উৎসাহ প্রকাশ করিল। ঘরের মধ্যে স্থানাভাব, লোকাভাব, অন্নাভাব, কিন্তু ক্ষুদ্র ছিদ্র হইতে ফোয়ারা যেমন চতুৰ্গুণ বেগে উখিত হয়, তেমনি দারিদ্র্যের সংকীর্ণ মুখ হইতে আনন্দ পরিপূর্ণ ধারায় উচ্ছসিত হইতে লাগিল। এমনি করিয়া তিনদিন কাটিল। দুইবেল নিয়মিত স্টীমার আসিয়া লাগে, কত লোক, কত কোলাহল ; সন্ধ্যাবেলায় নদীতীর একেবারে নির্জন হইয়া যায়, তখন কী অবাধ স্বাধীনতা। এবং তিন জনে মিলিয়া নানাপ্রকার জোগাড় করিয়া, ভুল করিয়া, এক করিতে আর-এক করিয়া তুলিয়া রাধাবাড়া। তাহার পরে মৃন্ময়ীর বলয়বংকৃত স্নেহহন্তের পরিবেশনে শ্বশুর জামাতার একত্রে আহার এবং গৃহিণীপনার সহস্র ত্রুটি প্রদর্শনপূর্বক মৃন্ময়ীকে পরিহাস ও তাঁহা লইয়া বালিকার আনন্দকলহ এবং মৌখিক অভিমান। অবশেষে