পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অনেক রাত্রে হঠাৎ চাঁদ উঠিয়া চাঁদের আলো বিছানার উপর আসিয়া পড়িল। অপূর্ব সেই আলোকে মৃন্ময়ীর দিকে চাহিয়া দেখিল। চাহিয়া চাহিয়া মনে হইল যেন রাজকন্যাকে কে রুপার কাঠি হেঁয়াইয়া অচেতন করিয়া রাখিয়া গিয়াছে। একবার কেবল সোনার কাঠি পাইলেই এই নিদ্রিত আত্মটিকে জাগাইয়া তুলিয়া মালা বদল করিয়া লওয়া যায়। রুপার কাঠি হাস্য, আর সোনার কাঠি অশ্রুজল। ভোরের বেলায় অপূর্ব মৃন্ময়ীকে জাগাইয়া দিল- কহিল, “মৃন্ময়ী, আমার যাইবার সময় হইয়াছে। চলো তোমাকে তোমার মার বাড়ি রাখিয়া আসি।” মৃন্ময়ী শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাড়াইলে অপূর্ব তাহার দুই হাত ধরিয়া কহিল, “এখন আমার একটি প্রার্থনা আছে। আমি অনেক সময় তোমার অনেক সাহায্য করিয়াছি, আজ যাইবার সময় তাহার একটি পুরস্কার দিবে ?” भूशी विशिष्ठ श्शा बश्लि, “दी।” অপূর্ব কহিল, “তুমি ইচ্ছা করিয়া ভালোবাসিয়া আমাকে একটি চুম্বন দাও।” অপূৰ্বর এই অদ্ভুত প্রার্থনা এবং গভীর মুখভােব দেখিয়া মৃন্ময়ী হাসিয়া উঠিল। হাস্য সংবরণ করিয়া মুখ বাড়াইয়া চুম্বন করিতে উদ্যত হইল-কাছাকাছি গিয়া আর পরিল না, খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। এমন দুইবার চেষ্টা করিয়া অবশেষে নিরন্ত হইয়া মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিল। শাসনচ্ছলে অপূর্ব उाशन कभभूल शशि नाड़िशा निल। অপূৰ্বর বড়ো কঠিন পণ্য। দস্যবৃত্তি করিয়া কড়িয়া লুটিয়া লওয়া সে আত্মবিমাননা মনে করে। সে দেবতার ন্যায় সগীেরবে থাকিয়া স্বেচ্ছানীত উপহার চায়, নিজের হাতে কিছুই তুলিয়া লইবে না। মৃন্ময়ী আর হাসিল না। তাহাকে প্রতুষের আলোকে নির্জন পথ দিয়া তাহার মাের বাড়ি রাখিয়া অপূর্ব গৃহে আসিয়া মাতাকে কহিল, “ভাবিয়া দেখিলাম, বউকে আমার সঙ্গে কলিকাতায় লইয়া গেলে আমার পড়াশুনার ব্যাঘাত হইবে, সেখানে উহারও কেহ সঙ্গিনী নাই। তুমি তো তাহাকে এ বাড়িতে রাখিতে চাও না, আমি তাই তাহার মার বাড়িতেই রাখিয়া আসিলাম।” সুগভীর অভিমানের মধ্যে মাতাপুত্রের বিচ্ছেদ হইল। সপ্তম পরিচ্ছেদ মাের বাড়িতে আসিয়া মৃন্ময়ী দেখিল কিছুতেই আর মন লাগিতেছে না। সে বাড়ির আগাগােড়া যেন বদল হইয়া গেছে। সময় আর কাটে না। কী করবে, কোথায় যাইবে, কাহার সহিত দেখা করিবে, ভাবিয়া পাইল N মৃন্ময়ীর হঠাৎ মনে হইল যেন সমস্ত গৃহে এবং সমস্ত গ্রামে কেহ লোক নাই! যেন মধ্যাহ্নে সূর্যগ্ৰহণ হইল। কিছুতেই বুঝিতে পারিল না, আজ কলিকাতায় চলিয়া যাইবার জন্য এত প্ৰাণপণ ইচ্ছা করিতেছে, কাল রাত্রে এই ইচ্ছা কোথায় ছিল ; কাল সে জানিত না যে, জীবনের যে-অংশ পরিহার করিয়া যাইবার জন্য এত মন-কেমন করিতেছিল তৎপূর্বেই তাহার সম্পূর্ণ স্বাদ-পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে। গাছের পঙ্কপত্রের ন্যায় আজ সেই বৃন্তচু্যত অতীত জীবনটাকে ইচ্ছাপূর্বক অনায়াসে দূরে টুড়িয়া ফেলিল। গল্পে শুনা যায়, নিপুণ অস্ত্রকার এমন সূক্ষ্মী তরবারি নির্মাণ করিতে পারে যে, তদ্বিারা মানুষকে দ্বিখণ্ড করিলেও সে জানিতে পারে না, অবশেষে নাড়া দিলে দুই অর্ধখণ্ড ভিন্ন হইয়া যায়। বিধাতার তরবারি সেইরূপ সূক্ষ্ম, কখন তিনি মৃন্ময়ীর বাল্য ও যৌবনের মাঝখানে আঘাত করিয়াছিলেন সে জানিতে পারে নাই ; আজ কেমন করিয়া নাড়া পাইয়া বাল্য অংশ যৌবন হইতে বিচুত হইয়া পড়িল এবং মৃন্ময়ী বিস্মিত মাতৃগৃহে তাহার সেই পুরাতন শয়নগৃহকে আর আপনার বলিয়া মনে হইল না, সেখানে যে থাকিত সে হঠাৎ আর নাই। এখন হৃদয়ের সমস্ত স্মৃতি সেই আর-একটা বাড়ি, আর-একটা ঘর, আর-একটা শয্যার কাছে গুনগুন করিয়া বেড়াইতে লাগিল।