পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

BOS রবীন্দ্ররচনাবলী খাতা লিখিতে শিখিয়া অবধি উমা বিষম উপদ্রব আরম্ভ করিয়াছে। বাড়ির প্রত্যেক ঘরের দেয়ালে কয়লা দিয়া বাকা লাইন কাটিয়া বড়ো বড়ো কঁচা অক্ষরে কেবলই লিখিতেছে- জল পড়ে, পাতা নড়ে। তাহার বউঠাকুরানীর বালিশের নীচে হরিদাসের গুপ্তকথা ছিল, সেটা সন্ধান করিয়া বাহির করিয়া তাহার পাতায় পাতায় পেনসিল দিয়া লিখিয়ছে- কালো জল, লাল ফুল। বাড়ির সর্বদা ব্যবহার্য নূতন পঞ্জিকা হইতে অধিকাংশ তিথিনক্ষত্র খুব বড়ো বড়ো অক্ষরে একপ্রকার লুপ্ত করিয়া দিয়াছে। বাবার দৈনিক হিসাবের খাতায় জমাখরচের মাঝখানে লিখিয়া রাখিয়ছে- লেখাপড়া করে যেই গাড়িঘোড়া চড়ে সেই । E፡ এ প্রকার সাহিত্যচর্চায় এ পর্যন্ত সে কোনোপ্রকার বাধা পায় নাই, অবশেষে একদিন একটা গুরুতর मूचना शलि। 通 উমার দাদা গোবিন্দলাল দেখিতে অত্যন্ত নিরীহ, কিন্তু সে খবরের কাগজে সর্বদাই লিখিয়া থাকে। তাহার কথাবার্তা শুনিলে তাহার আত্মীয়স্বজন কিংবা তাহার পরিচিত প্রতিবেশীরা কেহ তাহাকে চিন্তাশীল বলিয়া কখনো সন্দেহ করে না । এবং বাস্তবিকও সে যে কোনো বিষয়ে কখনো চিন্তা করে এমন অপবাদ তাহাকে দেওয়া যায় না, কিন্তু সে লেখে; এবং বাংলার অধিকাংশ পাঠকের সঙ্গে তার মতের সম্পূর্ণ ঐক্য হয় । শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে যুরোপীয় বৈজ্ঞানিকমণ্ডলীর মধ্যে কতকগুলি গুরুতর ভ্রম প্রচলিত আছে, সেগুলি গোবিন্দলাল যুক্তির কোনাে সাহায্য অবলম্বন না করিয়াও কেবলমাত্র রোমাঞ্চজনক ভাষার প্রভাবে সতেজে খণ্ডনপূর্বক একটি উপাদেয় প্রবন্ধ রচনা করিয়াছিল। উমা একদিন নির্জন দ্বিপ্রহরে দাদার কালিকলম লইয়া সেই প্রবন্ধটির উপরে বড়ো বড়ো করিয়া লিখিল- গোপাল বড়ো ভালো ছেলে, তাহাকে যাহা দেওয়া যায় সে তাঁহাই খায় । গোপাল বলিতে সে যে গোবিন্দলালের প্রবন্ধ-পাঠকদের প্রতি বিশেষ লক্ষ করিয়াছিল। তাহা আমার বিশ্বাস হয় না, কিন্তু দাদার ক্রোধের সীমা ছিল না। প্রথমে তাহাকে মারিল, অবশেষে তাহার একটি স্বল্পাবশিষ্ট পেনসিল, আদ্যোপােন্ত মসীলিপ্ত একটি ভেঁাতা। কলম, তাহার বহু যত্নসঞ্চিত যৎসামান্য লেখোপকরণের পুঁজি কাডিয়া লইল। অপমানিত বালিকা তাহার এতাদৃশ গুরুতর লাঞ্ছনার কারণ সম্পূর্ণ বুঝিতে না পারিয়া ঘরের কোণে বসিয়া ব্যথিতহাদয়ে কঁদিতে লাগিল। শাসনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হইলে পর গোবিন্দলাল কিঞ্চিৎ অনুতপ্তচিত্তে উমাকে তাহার লুষ্ঠিত সামগ্ৰীগুলি ফিরাইয়া দিল এবং উপরন্তু একখানি লাইন টানা ভালো বঁধানো খাতা দিয়া বালিকার হৃদয়বেদনা দূর করিবার চেষ্টা করিল। উমার বয়স তখন সাত বৎসর। এখন হইতে এই খাতাটি রাত্রিকালে উমার বালিশের নীচে ও দিনের বেলা সর্বদা তাহার কক্ষে ক্ৰোড়ে বিরাজ করিতে লাগিল । ছোটাে বেণীটি বাধিয়া বি সঙ্গে করিয়া যখন সে গ্রামের বালিকাবিদ্যালয়ে পড়িতে যাইত খাতাটি সঙ্গে সঙ্গে যাইত। দেখিয়া মেয়েদের কাহারও বিস্ময়, কাহারও লোভ, কাহারও বা দ্বেষ হইত । প্রথম বৎসরে অত যত্ন করিয়া খাতায় লিখিল- পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল। শয়নগৃহের মেঝের উপরে বসিয়া খাতাটি আঁকড়িয়া ধরিয়া উচ্চৈঃস্বরে সুর করিয়া পড়িত এবং লিখিত। এমনি করিয় অনেক গদ্য পদ্য সংগ্ৰহ হইল। দ্বিতীয় বৎসরে মধ্যে মধ্যে দুটি একটি স্বাধীন রচনা দেখা দিতে লাগিল ; অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত সারবান- ভূমিকা নাই, উপসংহার নাই। দুটা-একটা উদ্যুত করিয়া দেওয়া যাইতে পারে। খাতায় কথামালার ব্যােন্ত্র ও বকের গল্পটা যেখানে কপি করা আছে, তাহার নীচে এক জায়গায় একটি লাইন পাওয়া গেল, সেটা কথামােলা কিংবা বর্তমান বঙ্গসাহিত্যের আর কোথাও ইতিপূর্বে দেখা যায় নাই