পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

808 রবীন্দ্র-রচনাবলী গোবিন্দলাল বলে, এখন উমর পতিভক্তি শিক্ষার সময়, এখন তাহাকে মাঝে মাঝে পতিগৃহ হইতে পুরাতন পিতৃস্নেহের মধ্যে আনয়ন করিলে তাহার মনকে অনর্থক বিক্ষিপ্ত করিয়া দেওয়া হয়। এই বিষয়ে সে উপদেশে বিদূপে জড়িত এমন সুন্দর প্রবন্ধ লিখিয়ছিল যে, তাহার একমতবর্তী সকল পাঠকেই উক্ত রচনার অকাটা সত্য সম্পূর্ণ স্বীকার না করিয়া থাকিতে পারে নাই। লোকমুখে সেই কথা শুনিয়াই উমা তাহার খাতায় লিখিয়াছিল--দাদা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে একবার তোমাদের ঘরে নিয়ে যাও, আমি তোমাকে আর কখনো রাগাব না। একদিন উমা দ্বার রুদ্ধ করিয়া এমনি কী একটা অর্থহীন তুচ্ছ কথা খাতায় লিখিতেছিল। তাহার ননদ তিলকমঞ্জরীর অত্যন্ত কৌতুহল হইল- সে ভাবিল বউদিদি মাঝে মাঝে দরজা বন্ধ করিয়া কী করে দেখিতে হইবে। দ্বারের ছিদ্ৰ দিয়া দেখিল লিখিতেছে। দেখিয়া অবাক । তাঁহাদের অন্তঃপুরে কখনোই সরস্বতীর এরাপ গোপন সমাগম হয় নাই । তাহার ছোটাে কনকমঞ্জরী, সে-ও আসিয়া একবার উকি মারিয়া দেখিল তাহার ছোটাে অনঙ্গমঞ্জরী, সে-ও পদাঙ্গুলির উপর ভরদিয়া বহুকষ্ট্রে ছিদ্রপথ দিয়া রুদ্ধগৃহের রহস্য ভেদ दिशां ळशैल । উমা লিখিতে লিখিতে সহসা গৃহের বাহিরে তিনটি পরিচিত কণ্ঠের খিলখিল হাসি শুনিতে পাইল। ব্যাপারটা বুঝিতে পারিল, খাতটি তাড়াতাড়ি বাক্সে বন্ধ করিয়া লজ্জায় ভয়ে বিছানায় মুখ লুকাইয়া পড়িয়া রহিল । প্যারীমোহন এই সংবাদ অবগত হইয়া বিশেষ চিন্তিত হইল। পড়াশুনা আরম্ভ হইলেই নভেল-নাটকের আমদানি হইবে এবং গৃহধর্ম রক্ষা করা দায় হইয়া উঠিবে। তা ছাড়া বিশেষ চিন্তা দ্বারা এ বিষয়ে সে একটি অতি সূক্ষ্মতত্ত্ব নির্ণয় করিয়াছিল। সে বলিত, স্ত্রীশক্তি এবং পুশক্তি উভয় শক্তির সম্মিলনে পবিত্র দাম্পত্যশক্তির উদ্ভব হয়; কিন্তু লেখাপড়া শিক্ষার দ্বারা যদি স্ত্রীশক্তি পরাভূত হইয়া একান্ত পুশক্তির প্রাদুর্ভাব হয়, তবে পূর্ণশক্তির সহিত পুশক্তির প্রতিঘাতে এমন একটি প্ৰলয়,শক্তির উৎপত্তি হয় যদ্বারা দাম্পত্যশক্তি বিনাশশক্তির মধ্যে বিলীনসত্তা লাভ করে, সুতরাং রমণী বিধবা হয় । এ পর্যন্ত এ তত্ত্বের কেহ প্ৰতিবাদ করিতে পারে নাই। প্যারীমোহন সন্ধ্যাকালে ঘরে আসিয়া উমাকে যথেষ্ট ভৎসনা করিল এবং কিঞ্চিৎ উপহাসও করিলবলিল, “শ্যামলা ফরমাশ দিতে হইবে, গিয়ী কানে কলম গুজিয়া আপিসে যাইবেন।” উমা ভালো বুঝিতে পারিল না। প্যারীমােহনের প্রবন্ধ সে কখনাে পড়ে নাই এইজন্য তাহার এখােন ততদূর রসবােধ জন্মে নাই। কিন্তু সে মনে মনে একান্ত সংকুচিত হইয়া গেলা— মনে হইল পৃথিবী দ্বিধ হইলে তবে সে লজা রক্ষা করিতে পারে। । বহুদিন আর সে লেখে নাই। কিন্তু একদিন শরৎকালের প্রভাতে একটি গায়িকা ভিখারিনী আগমনী, গান গাহিতেছিল। উমা জানালার গরীদের উপর মুখ রাখিয়া চুপ করিয়া শুনিতেছিল। একে শরৎকালে রৌদ্রে ছেলেবেলাকার সকল কথা মনে পড়ে, তাহার উপরে আগমনীর গান শুনিয়া সে আর থাকিতে পারি, कीं । উমা গান গাহিতে পারিত না ; কিন্তু লিখিতে শিখিয়া অবধি এমনি তাহার অভ্যাস হইয়াছে যে, একটি গান শুনিলেই সেট, লিখিয়া লইয়া গান গাহিতে না পারার খেদ মিটাইত। আজ কাঙালি গাহিতেছিল পুরবাসী বলে উমার মা, তোর হারা তারা এল ওই । শুনে পাগলিনীপ্রায়, অমনিরানী ধায়, क३७शायजिकड्ने। কেঁদে রানী বলে, আমার উমা এলে, একবার আয়ম, একবার আয়ম, । একবার আয় মা করি কোলে । ।