পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8&Q রবীন্দ্র-রচনাবলী বুঝিতাম না। প্রত্যহ সেই একটা অর্থহীন একঘেয়ে ব্যাপারে যোগ দেওয়া আমাদের কাছে সুখকর ছিল না। অথচ ইস্কুলের কর্তৃপক্ষেরা তখনকার কোনাে একটা থিয়োরি অবলম্বন করিয়া বেশ নিশ্চিন্ত ছিলেন যে, তাহারা ছেলেদের আনন্দবিধান করিতেছেন ; কিন্তু প্রত্যক্ষ ছেলেদের দিকে তাকাইয়া তাহার ফলাফল বিচার করা সম্পূর্ণ বাহুল্য বােধ করিতেন। যেন তাঁহাদের থিয়ােরি অনুসারে আনন্দ পাওয়া ছেলেদের একটা কর্তব্য, না পাওয়া তাহাদের অপরাধ। এইজন্য যে ইংরেজি বই হইতে র্তাহারা থিয়োরি সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন, তাহা হইতে আস্ত ইংরেজি গানটা তুলিয়া তাহারা আরাম বোধ করিয়াছিলেন । আমাদের মুখে সেই ইংরেজিটা কী ভাষায় পরিণত হইয়াছিল, তাহার আলোচনা শব্দতত্ত্ববিদগণের পক্ষে নিঃসন্দেহ মূল্যবান। কলোকী পুলোেকীসিংগিল মেলালিং মেলালিং মেলালিং। অনেক চিন্তা করিয়া ইহার কিয়দংশের মূল উদ্ধার করিতে পারিয়াছি- কিন্তু কিলোকী কথাটা যে কিসের রূপান্তর তাহা আজও ভাবিয়া পাই নাই। বাকি অংশটা আমার বোধ হয়- Full of glee, singing merrily, merrily, merrily. ক্রমশ নর্মল স্কুলের স্মৃতিটা যেখানে ঝাপসা অবস্থায় পার হইয়া ফুটতর হইয়া উঠিয়াছে সেখানে কোনো অংশেই তাহা লেশমাত্ৰ মধুর নহে।” ছেলেদের সঙ্গে যদি মিশিতে পরিতাম, তবে বিদ্যশিক্ষার দুঃখ তেমন অসহ্য বোধ হইত না। কিন্তু সে কোনোমতেই ঘটে নাই। অধিকাংশ ছেলেরই সংস্রব এমন অশুচি ও অপমানজনক ছিল যে, ছুটির সময় আমি চাকরকে লইয়া দোতলায় রাস্তার দিকের এক জানলার কাছে একলা বসিয়া কাটাইয়া দিতাম। মনে মনে হিসাব করিতাম, এক বৎসর, দুই বৎসর, তিন বৎসর- আরো কত বৎসর এমন করিয়া কাঁটাইতে হইবে । শিক্ষকদের মধ্যে একজনের কথা আমার মনে আছে, তিনি এমন কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করিতেন যে র্তাহার প্রতি অশ্রদ্ধাবশত র্তাহার কোনাে প্রশ্নেরই উত্তর করিতাম না । সংবৎসর তাহার ক্লাসে আমি সকল ছাত্রের শেষে নীরবে বসিয়া থাকিতাম। যখন পড়া চলিত তখন সেই অবকাশে পৃথিবীর অনেক দুরূহ সমস্যার মীমাংসচেষ্টা করিতাম। একটা সমস্যার কথা মনে আছে। অস্ত্ৰহীন হইয়াও শক্রকে কী করিলে যুদ্ধে হারানো যাইতে পারে, সেটা আমার গভীর চিন্তার বিষয় ছিল। ঐ ক্লাসের পড়াশুনার গুঞ্জনধ্বনির মধ্যে বসিয়া ঐ কথাটা মনে মনে আলোচনা করিতাম, তাহা আজও আমার মনে আছে। ভাবিতাম, কুকুর বাঘ প্রভৃতি হিংস্ৰ জন্তুদের খুব ভালো করিয়া শায়েস্তা করিয়া, প্রথমে তাহাদের দুই-চারি সার যুদ্ধক্ষেত্রে যদি সাজাইয়া দেওয়া যায়, তবে লড়াইয়ের আসরের মুখবন্ধটা বেশ সহজেই জমিয়া ওঠে ; তাহার পরে নিজেদের বাহুবল কাজে খাটাইলে জয়লাভটা নিতান্ত অসাধ্য হয় না। মনে মনে এই অত্যন্ত সহজ প্রণালীর রণসজ্জার ছবিটা যখন কল্পনা করিতাম তখন যুদ্ধক্ষেত্রে স্বপক্ষের জয় একেবারে সুনিশ্চিত দেখিতে পাইতাম। যখন হাতে কাজ ছিলনা। তখন কাজের অনেক আশ্চর্যসহজ উপায় বাহির করিয়াছিলাম। কাজ করিবার বেলায় দেখিতেছি, যাহা কঠিন তাহা কঠিনই, যাহা দুঃসাধ্য তাহা পুরস্কােত সি অঙ্গুলি আয় কণ্ঠ দি সৱে কবির চেষ্টা করিলে অসুবিধা আরো সাতগুণ এমনি করিয়া সেই ক্লাসে এক বছর যখন কাটিয়া গেল তখন মধুসূদন বাচস্পতির নিকট আমাদের বাংলার বাৎসরিক পরীক্ষা হইল। সকল ছেলের চেয়ে আমি বেশি নম্বর পাইলাম। আমাদের ক্লাসের শিক্ষক কর্তৃপুরুষদের কাছে জানাইলেন যে পরীক্ষক আমার প্রতি পক্ষপাত প্রকাশ করিয়াছেন। দ্বিতীয়বার আমার পরীক্ষা হইল। এবার স্বয়ং সুপারিন্টেন্ডেন্ট পরীক্ষকের পাশে টােকি লইয়া বসিলেন। এবারেও ভাগ্যক্রমে আমি উচ্চস্থান পাইলাম। : ১ “গিরি বলিয়া একটা ছােটােগল্প লিখিয়ছিলাম, সেটা নর্মালম্বুলেরই স্মৃতি হইতে লিখিত।”— পাণ্ডুলিপি ৩. নির্মল স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক ।