পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

छैदनशूठि 8२१ জোয়ারভাটার আসা-যাওয়া, সেই কতরকম রকম নীেকার কত গতিভঙ্গি, সেই পেয়ারাগাছের ছায়ার পশ্চিম হইতে পূর্ব দিকে অপসারণ, সেই কোন্নগরের পরে শ্রেণীবদ্ধ বানান্ধকারের উপর বিদীর্ণবক্ষ সূর্যন্তিকালের অজস্র স্বর্ণশোণিতপ্লাবন। এক-একদিন সকাল হইতে মেঘ করিয়া আসে ; ওপারের গাছগুলি কালো ; নদীর উপর কালো ছায়া ; দেখিতে দেখিতে সশব্দ বৃষ্টির ধারায় দিগন্ত ঝাপসা হইয়া যায়, ওপারের তটরেখা যেন চােখের জলে বিদায়গ্ৰহণ করে ; নদী ফুলিয়া ফুলিয়া উঠে এবং ভিজা হাওয়া এপারের ডালপালাগুলার মধ্যে যা-খুশি তাই করিয়া বেড়ায়। কড়ি-বরগা-দেয়ালের জঠরের মধ্য হইতে বাহিরের জগতে যেন নূতন জন্মলাভ করিলাম। সকল জিনিসকেই আর-একবার নূতন করিয়া জানিতে গিয়া, পৃথিবীর উপর হইতে অভ্যাসের তুচ্ছতার আবরণ : একেবারে ঘুচিয়া গেল। সকালবেলায় এখোগুড় দিয়া যে বাসি লুচি খাইতাম, নিশ্চয়ই স্বৰ্গলোকে ইন্দ্র যে-অমৃত খাইয়া থাকেন তাহার সঙ্গে তার স্বাদের বিশেষ কিছু পার্থক্য নাই। কারণ, অমৃত জিনিসটা রসের মধ্যে নাই, রসবোধের মধ্যেই আছে- এইজন্য যাহারা সেটাকে খোজে। তাহারা সেটাকে পায়ই না । যেখানে আমরা বসিতাম। তাহার পিছনে প্রাচীর দিয়া ঘেরা ঘাটবাঁধানো একটা খিড়কির পুকুর- ঘাটের পাশেই একটা মস্ত জামরুল গাছ ; চারিধারেই বড়ো বড়ো ফলের গাছ ঘন হইয়া দাড়াইয়া ছায়ার আড়ালে পুষ্করিণীটির আবরু রচনা করিয়া আছে। এই ঢাকা, ঘেরা, ছায়া-করা সংকুচিত একটুখানি খিড়কির বাগানের ঘোমটা-পরা সৌন্দৰ্য আমার কাছে ভারি মনোহর ছিল। সম্মুখের উদার গঙ্গাতীরের সঙ্গে এর কতই তফাত । এ যেন ঘরের বধু। কোণের আড়ালে, নিজের হাতের লতাপাত আঁকা সবুজ রঙের কথাটি মেলিয়া দিয়া মধ্যাহের নিভৃত অবকাশে মনের কথাটিকে মৃদুগুঞ্জনে ব্যক্ত করিতেছে। সেই মধ্যাহোঁই অনেকদিন জামরুলগাছের ছায়ায়, ঘাটে একলা বসিয়া পুকুরের গভীর তলাটার মধ্যে যক্ষপুরীর ভয়ের রাজ্য কল্পনা করিয়াছি। বাংলাদেশের পাড়াগীটাকে ভালো করিয়া দেখিবার জন্য অনেক দিন হইতে মনে আমার ঔৎসুক্য ছিল। গ্রামের ঘরবস্তি চণ্ডীমণ্ডপ রাস্তাঘাট খেলাধুলা হটমােঠ জীবনযাত্রার কল্পনা আমার হৃদয়কে অত্যন্ত টানিত । সেই পাড়াগা এই গঙ্গাতীরের বাগানের ঠিক একেবারে পশ্চাতেই ছিল- কিন্তু সেখানে আমাদের যাওয়া নিষেধ। আমরা বাহিরে আসিয়াছি কিন্তু স্বাধীনতা পাই নাই। ছিলাম খাচায়, এখন বসিয়াছি দাড়ে- পায়ের শিকল কাটিল না । একদিন আমার অভিভাবকের মধ্যে দুইজনে সকালে পাড়ায় বেড়াইতে গিয়াছিলেন। আমি কৌতুহলের আবেগ সামলাইতে না পারিয়া ঠাঁহাদের অগোচরে পিছনে পিছনে কিছুদূর গিয়াছিলাম। গ্রামের গলিতে ঘনবনের ছায়ায় শেওড়ার-বেড়া-দেওয়া পানাপুকুরের ধারাদিয়া চলিতে চলিতে বড়ো আনন্দে এই ছবি মনের মধ্যে আঁকিয়া আঁকিয়া লইতেছিলাম। একজন লোক অত বেলায় পুকুরের ধারে খোলা গায়ে দাঁতন করিতেছিল, তাহা আজও আমার মনে রহিয়া গিয়াছে। এমন সময়ে আমার অগ্রবর্তীরা হঠাৎ টের পাইলেন, আমি পিছনে আছি। তখনই ভৎসনা করিয়া উঠিলেন, “যাওয়াও, এখনি ফিরে যাও।”- তাহদের মনে হইয়াছিল বাহির হইবার মতো সাজ আমার ছিল না। পায়ে আমার মোজা নাই, গায়ে একখানি জামার উপর অন্য-কোনো ভদ্র আচ্ছাদন নাই- ইহাকে তাহারা আমার অপরাধ বলিয়া গণ্য করলেন । কিন্তু মোজা এবং পােশাকপরিচ্ছদের কোনাে উপসর্গ আমার ছিলই না, সুতরাং কেবল সেইদিনই যে হতাশ হইয়া আমাকে ফিরিতে হইল তাহা নহে, ত্রুটি সংশোধন করিয়া ভবিষ্যতে আর-একদিন বাহির হইবার উপায়ও রহিল না। সেই পিছনে আমার বাধা রহিল। কিন্তু গঙ্গা সম্মুখ হইতে আমার সমস্ত বন্ধন হরণ করিয়া লইলেন। পাল-তোলা নীেকায় যখন তখন আমার মন বিনাভাড়ায় সওয়ারি হইয়া বসিত এবং যে-সব দেশে যাত্রা । করিয়া বাহির হইত, ভূগোলে আজ পর্যন্ত তাঁহাদের কোনাে পরিচয় পাওয়া যায় নাই। সে হয়তো আজ চল্লিশ বছরের কথা। তার পর সেই বাগানের পুষ্পিত চাপাতলার স্নানের ঘাটে আর একদিনের জন্যও পদার্পণ করি নাই। সেই গাছপালা, সেই বাড়িঘর নিশ্চয়ই এখনো আছে, কিন্তু জানি সে বাগান আর নাই ; কেননা, বাগান তো গাছপালা দিয়া তৈরি নয়, একটি বালকের নববিস্ময়ের আনন্দ দিয়া সে গড়া- সেই নববিস্ময়টি এখন কোথায় পাওয়া যাইবে ?