পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

80 রবীন্দ্র-রচনাবলী তখনো নীচে বসিয়া আছেন আমাদের নীলকমল পণ্ডিতমহাশয় ; বাংলা জ্যামিতির বইখানা তখনো খোলা এবং মেঘনাদবধ কাব্যখন বােধ করি পুনরাবৃত্তির সংকল্প চলিতেছে। কিন্তু মৃত্যুকালে পরিপূর্ণ ঘরকন্নার বিচিত্র আয়োজন মানুষের কাছে যেমন মিথ্যা প্রতিভাত হয়, আমাদের কাছেও পণ্ডিতমশায় হইতে আরম্ভ করিয়া আর ঐ বাের্ডে টাঙাইবার পেরেকটা পর্যন্ত তেমনি একমুহূর্তে মায়াময়ীচিকার মতো শূন্য হইয়া গিয়াছে। কী রকম করিয়া যথোচিত গভীর্য রাখিয়া পণ্ডিতমহাশয়কে আমাদের নিকৃতির খবরটা দিব, সেই এক মুশকিল হইল। সংযতভাবেই সংবাদটা জানাইলাম। দেয়ালে টাঙানো কালো বোর্ডের উপরে জ্যামিতির বিচিত্র রেখাগুলা আমাদের মুখের দিকে একদৃষ্টি তাকাইয়া রহিল ; যে-মেঘনাদবধের প্রত্যেক অক্ষরটিই আমাদের কাছে অমিত্র ছিল সে আজ এতই নিরীহভাবে টেবিলের উপর চিত হইয়া পড়িয়া রহিল। যে, তাহাকে আজ মিত্র বলিয়া কল্পনা করা অসম্ভব ছিল না। বিদায় লইবার সময় পণ্ডিতমহাশয় কহিলেন, “কর্তব্যের অনুরোধে তোমাদের প্রতি অনেকসময় অনেক কঠোর ব্যবহার করিয়াছি, সে কথা মনে রাখিয়ে না। তোমাদের যাহা শিখাইয়াছি। ভবিষ্যতে তাহার মূল্য বুঝিতে পরিবে ।” মূল্য বুঝিতে পারিয়াছি। ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতেছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিল। শিক্ষা-জিনিসটা যথাসম্ভব। আহার-ব্যাপারের মতো হওয়া উচিত। খাদ্যদ্রব্যে প্রথম কামড়টা দিবামাত্রেই তাহার স্বাদের সুখ আরম্ভ হয়, পেট ভরিবার পূর্ব হইতেই পেটটি খুশি হইয়া জাগিয়া উঠেতাহাতে তাহার জারক রসগুলির আলস্য দূর হইয়া যায়। বাঙালির পক্ষে ইংরেজি শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই । তাহার প্রথম কামড়েই দুইপটি দাঁত আগাগোড়া নড়িয়া উঠে- মুখবিবরের মধ্যে একটা ছোটােখাটাে অবতারণা হয় । তার পরে, সেটা যে লোষ্ট্রজাতীয় পদার্থী নহে, সেটা যে রাসে-পাক-করা মোদকবন্ত, তাহাবুঝিতে বুঝিতেই বয়স অর্ধেক পার হইয়া যায়। বানানে ব্যাকরণে বিষম লাগিয়া নাক-চোখ দিয়া যখন অজস্র জলাধারা বহিয়া যাইতেছে, অন্তরটা তখন একেবারেই উপবাসী হইয়া আছে । অবশেষে বহুকষ্টে অনেক দেরিতে খাবারের সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটে তখন ক্ষুধাটাই যায় মরিয়া। প্রথম হইতেই মনটাকে চালনা করিবার সুযোগ না পাইলে মনের চলৎশক্তিতেই মন্দা পড়িয়া যায়। যখন চারি দিকে খুব কষিয়া ইংরেজি পড়াইবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে তখন যিনি সাহস করিয়া আমাদিগকে দীর্ঘকাল বাংলা শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেই আমার স্বৰ্গগত। সেজদাদার উদ্দেশে সকৃতজ্ঞ প্ৰণাম নিবেদন করিতেছি । নর্মাল স্কুল ত্যাগ করিয়া আমরা বেঙ্গল একাডেমি” নামক এক ফিরিঙ্গি স্কুলে ভরতি হইলাম। ইহাতে আমাদের গৌরব কিছু বাড়িল। মনে হইল, আমরা অনেকখানি বড়ো হইয়াছি- অন্তত স্বাধীনতার প্রথম তলাটাতে উঠিয়ছি। বস্তুত, এ বিদ্যালয়ে আমরা যেটুকু অগ্রসর হইয়াছিলাম সে কেবলমাত্র ঐ স্বাধীনতার দিকে । সেখানে কী-যে পড়িতেছি তাহা কিছুই বুঝিতাম না, পড়াশুনা করিবার কোনো চেষ্টাই করিতাম নানা করিলেও বিশেষ কেহ লক্ষ করিত না। এখানকার ছেলেরা ছিল দুৰ্বত্ত কিন্তু ঘূণ্য ছিল না, সেইটে অনুভব করিয়া খুব আরাম পাইয়াছিলাম। তাহারা হাতের তেলোয় উলটা করিয়া as লিখিয়া হেলো বলিয়া যেন আদর করিয়া পিঠে চাপড় মারিত, তাহাতে জনসমাজে অবজ্ঞাভাজন উক্ত চতুস্পদের নামাক্ষরটি পিঠের কাপড়ে অঙ্কিত হইয়া যাইত ; হয়তো বা হঠাৎ চলিতে চলিতে মাথার উপরে খানিকটা কলা থেতলাইয়া দিয়া কোথায় অন্তৰ্হিত হইত, ঠিকানা পাওয়া যাইত না ; কখনো বা ধা করিয়া মারিয়া অত্যন্ত নিরীহ ভালোমানুবটির মতো অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া থার্কিত, দেখিয়া পরম সাধু বলিয়া ভ্ৰম হইত। এ সকল উৎপীড়ন গায়েই লাগে, মনে ছাপ দেয় না- এ সমস্তইউৎপাতিমাত্র, অপমান নহে। তাই আমার মনে হইল, এ যেন পাকের থেকে উঠিয়া পাথরে পা দিলাম- তাহাতে পা কাটিয়া যায় সেও ভালো, কিন্তু মলিনতা হইতে রক্ষণ পাওয়া গেল। এই বিদ্যালয়ে আমার মতো ছেলের একটা মন্ত সুবিধা এই ছিল যে, আমরা যে লেখাপড়া করিয়া উন্নতিলাভ করিব সেই অসম্ভব দুরাশা আমাদের সম্বন্ধে কাহারও মনে ছিল না। ছোটাে ১ “ডিক্‌রজ সাহেব [Decruz] ছিলেন ইস্কুলের মালিক।”-মুনশী, গল্পসল্প