পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88ひ রবীন্দ্র-রচনাবলী সেখানে গিয়াছিল। তাহার কাছে ভ্ৰমণবৃত্তান্ত যাহা শুনিয়ছিলাম, উনবিংশ শতাব্দীর কোনো ভদ্রঘরের শিশু তাহা কখনোই বিশ্বাস করিতে পারিত না । কিন্তু আমাদের সেকালে সম্ভাব-অসম্ভবের মাঝখানে সীমারেখাটা যে কোথায় তাহা ভালো করিয়া চিনিয়া রাখিতে শিখি নাই। কৃত্তিবাস, কাশীরামদাস এ-সম্বন্ধে আমাদের কোনো সাহায্য করেন নাই । রঙ করা ছেলেদের বই এবং ছবি-দেওয়া ছেলেদের কাগজ সত্যমিথ্যা সম্বন্ধে আমাদিগকে আগেভাগে সাবধান করিয়া দেয় নাই। জগতে যে একটা কড়া নিয়মের উপসৰ্গ আছে সেটা আমাদিগকে নিজে ঠেকিয়া শিখিতে হইয়াছে। সত্য বলিয়াছিল, বিশেষ দক্ষতা না থাকিলে রেলগাড়িতে চড়া এক ভয়ংকর সংকট- পা ফাঁসকাইয়া গেলেই আর রক্ষা নাই। তার পর, গাড়ি যখন চলিতে আরম্ভ করে তখন শরীরের সমস্ত শক্তিকে আশ্রয় করিয়া খুব জোর করিয়া বসা চাই, নহিলে এমন ভয়ানক ধাক্কা দেয় যে মানুষ কে কোথায় ছিটকাইয়া পড়ে তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না। স্টেশনে পীেছিয়া মনের মধ্যে বেশ একটু ভয়-ভয় করিতেছিল। কিন্তু গাড়িতে এত সহজেই উঠিলাম যে মনে সন্দেহ হইল, এখনো হয়তো গাড়ি-ওঠার আসল অঙ্গটাই বাকি আছে। তাহার পরে যখন অত্যন্ত সহজে গাড়ি ছাড়িয়া দিল তখন কোথাও বিপদের একটুও আভাস না পাইয়া মনটা বিমর্ষ হইয়া গেল । গাড়ি ছুটিয়া চলিল ; তরুশ্রেণীর সবুজ নীল পাড়-দেওয়া বিত্তীর্ণ মঠ এবং ছায়াচ্ছন্ন গ্রামগুলি রেলগাড়ির দুই ধারে দুই ছবির করনার মতো বেগে ছুটিতে লাগিল, যেন মরীচিকার বন্যা বহিয়া চলিয়াছে। সন্ধ্যার সময় বােলপুরে পৌছিলাম।” পালকিতে চড়িয়া চােখ বুজিলাম। একেবারে কাল সকালবেলায় বােলপুরের সমস্ত বিস্ময় আমার জাগ্ৰত চােখের সম্মুখে খুলিয়া যাইবে, এই আমার ইচ্ছা-সন্ধ্যার অস্পষ্টতার মধ্যে কিছু কিছু আভাস যদি পাই তবে কালকের অখণ্ড আনন্দের রসভঙ্গ হইবে । আমাকে বলিয়ছিল, পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের সঙ্গে বোলপুরের একটা বিষয়ে প্রভেদ এই ছিল যে, কুঠিবাড়ি হইতে রান্নাঘরে যাইবার পথে যদিও কোনো প্রকার আবরণ নাই। তবু গায়ে রৌদ্রবৃষ্টি কিছুই লাগে না । এই অদ্ভুত রাস্তাটা খুঁজতে বাহির হইলাম। পাঠকেরা শুনিয়া আশ্চর্য হইবেন না যে, আজ পর্যন্ত তাহা খুঁজিয়া পাই নাই । আমরা শহরের ছেলে, কোনোকালে ধানের খেত দেখি নাই এবং রাখালবালকের কথা বইয়ে পড়িয়া তাহাদিগকে খুব মনোহর করিয়া কল্পনার পটে আঁকিয়ছিলাম। সত্যর কাছে শুনিয়াছিলাম, বোলপুরের মাঠে চারি দিকেই ধান ফলিয়া আছে এবং সেখানে রাখাল বালকদের সঙ্গে খেলা প্ৰতিদিনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ধানখেতি হইতে চাল সংগ্ৰহ করিয়া ভাত রাধিয়া রাখালদের সঙ্গে একত্রে বসিয়া খাওয়া, এই খেলার go ga va i t ব্যাকুল হইয়া চারিদিকে চাহিলাম। হায় রে, মরুপ্রান্তরের মধ্যে কোথায় ধানের খেত। রাখালবালক গুৰুস্থ কােথাও কি, কিন্তু অপারে বলে তাঁর রাখার পর নির কােন s: a যাহা দেখিলাম না। তাহার খেদ মিটিতে বিলম্ব হইল না- যাহা দেখিলাম তাহাঁই আমার পক্ষে যথেষ্ট হইল। এখানে চাকরীদের শাসন ছিল না। প্রান্তরলক্ষ্মী দিক্‌চক্রবালে একটিমাত্র নীল রেখার গণ্ডি আঁকিয়া রাখিয়ছিলেন, তাহাতে আমার অবাধসঞ্চরণের কোনো ব্যাঘাত করিত না। " যদিচ আমি নিতান্ত ছোটাে ছিলাম। কিন্তু পিতা কখনো আমাকে যথেচ্ছবিহারে নিষেধ করিতেন না। বোলপুরের মাঠের মধ্যে স্থানে স্থানে বর্ধার জলধারায় বালিমাটি ক্ষয় করিয়া, প্রান্তরিতল হইতে নিদে, লাল কাকর ও নানাপ্রকার পাথরে খচিত ছোটাে ছোটাে শৈলমালা গুহাগহবর নদী উপনদী রচনা করিয়া, বালখিল্যদের দেশের ভুবৃত্তান্ত প্রকাশ করিয়াছে। এখানে এই টিবিওয়ালা খাদগুলিকে খেয়াই বলে। এখােন হইতে জামার আঁচলে নানা প্রকারের পাথর সংগ্ৰহ করিয়া পিতার কাছে উপস্থিত করিতাম। তিনি আমার ১ বাংলা ফাল্গুন, ১২৭৯