পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী করিতেন তবে ছোটাে ছোটাে অকুণ্ডলা শুনাইয়া যাইতে হইত। কোনো কোনো দিন এমন ঘটিয়াহে, হিসাবে যেখানে কোনো দুর্বলতা থাকিত সেখানে তাহার বিরক্তি ধাচাইবার জন্য চাপিয়া গিয়াছি, কিন্তু কখনো তাহা চাপ থাকে নাই। হিসাবের মোট চেহারা তিনি চিত্তপটে আঁকিয়া লইতেন। যেখানে ছিদ্র পড়িত সেইখনেই DD DDB BuBBDBSB BDB BD D BB DBu DDD DDD SB BDDuBS মনের মধ্যে সকল জিনিস সুস্পষ্ট করিয়া দেখিয়ালওয়া তাহার প্রকৃতিগত ছিল- তা হিসাবের অঙ্কই হােক বা প্রাকৃতিক দৃশ্যই হােক বা অনুষ্ঠানের আয়োজনই হােক। শান্তিনিকেতনের নূতন মন্দির প্রভৃতি অনেক জিনিস তিনি চক্ষে দেখেন নাই। কিন্তু যে-কেহ শান্তিনিকেতন দেখিয়া ঠাঁহার কাছে গিয়াছে, প্রত্যেক লোকের কােছ হইতে বিবরণ শুনিয়া তিনি অপ্রত্যক্ষ জিনিসগুলিকে মনের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে আঁকিয়া না লইয়া ছাড়েন নাই। তাহার স্মরণশক্তি ও ধারণাশক্তি অসাধারণ ছিল। সেইজন্য একবার মনের মধ্যে যাহা গ্ৰহণ করিতেন তাহা কিছুতেই তাহার মন হইতে ভ্ৰষ্ট হইত না। ভগবদগীতায় পিতার মনের মতো শ্লোকগুলি চিহ্নিত করা ছিল। সেইগুলি বাংলা অনুবাদ সমেত আমাকে কপি করিতে দিয়াছিলেন। বাড়িতে আমি নগণ্য বালক ছিলাম, এখানে আমার পরে এইসকল গুরুতর কাজের ভার পড়াতে তাহার গীেরবটা, খুব করিয়া অনুভব করিতে লাগিলাম। ইতিমধ্যে সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন নীল খাতটি বিদায় করিয়া একখানা বঁধানো লেটুস ডায়ারি সংগ্ৰহ করিয়াছিলাম। এখন খাতপত্র এবং বাহ্য উপকরণের দ্বারা কবিত্বের ইজ্জত রাখিবার দিকে দৃষ্টি পড়িয়ছে। , শুধু কবিতা লেখা নহে, নিজের কল্পনার সম্মুখে নিজেকে কবি বলিয়া খাড়া করিবার জন্য একটা চেষ্টা জন্সিয়াছে। এইজন্য বোলপুরে যখন কবিতা লিখিতাম তখন বাগানের প্রান্তে একটি শিশু নারিকেলগাছের তলায় মাটিতে পা ছড়াইয়া বসিয়া খাতা ভরাইতে ভালোবাসিতাম। এটাকে বেশ কবিজনে৷াচিত বলিয়া বোধ হইত। তৃণহীন কঙ্করশয্যায় বসিয়া রৌদ্রের উত্তাপে ‘পৃথিরাজের পরাজয়’ বলিয়া একটা বীররসাত্মক কাব্য লিখিয়ছিলাম। তাহার প্রচুর বীররসেও উক্ত কাব্যটাকে বিনাশের হাত হইতে রক্ষা করিতে পারে নাই। তাহার উপযুক্ত বাহন সেই বঁধানো লেটুস ডায়রিটিও জ্যেষ্ঠ সহােদরা নীল খাতাটির অনুসরণ করিয়া কোথায় গিয়াছে তাহার ঠিকানা কাহারও কাছে রাখিয়া যায় নাই । বোলপুর হইতে বাহির হইয়া সাহেবগঞ্জ, দানাপুর, এলাহাবাদ, কানপুর প্রভৃতি স্থানে মাঝে মাঝে বিশ্রাম করিতে করিতে অবশেষে অমৃতসরে গিয়া পৌছিলাম। পথের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটিয়ছিল যেটা এখনো আমার মনে স্পষ্ট আঁকা রহিয়াছে। কোনো-একটা বড়ো স্টেশনে গাড়ি থামিয়াছে। টিকিট পরীক্ষক আসিয়া আমাদের টিকিট দেখিল। একবার আমার মুখের দিকে চাহিল। কী একটা সন্দেহ করিল। কিন্তু বলিতে সাহস করিল না। কিছুক্ষণ পরে আর-একজন আসিল— উভয়ে আমাদের গাড়ির দরজার কাছে উসখুসি করিয়া আবার চলিয়া গেল। তৃতীয় বারে বােধ হয় স্বয়ং স্টেশনমাস্টার আসিয়া উপস্থিত। আমার হাফটিকিট পরীক্ষা করিয়া পিতাকে জিজ্ঞাসা করিল,“এই ছেলেটির বয়স কি বারো বছরের অধিক নহে।” পিতা কহিলেন, “না।” তখন আমার বয়স এগারো। বয়সের চেয়ে নিশ্চয়ই আমার বৃদ্ধি কিছু বেশি হইয়াছিল। স্টেশনমাস্টার কহিল, “ইহার জন্য পুরা ভাড়া দিতে হইবে।” আমার পিতার দুই চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। তিনি বাক্স হইতে তখনই নোট বাহির করিয়া দিলেন। ভাড়ার ঢাকা বাদ দিয়া অবশিষ্ট টাকা যখন তাহারা ফিরাইয়া দিতে আসিল তিনি সেটাকা লইয়া ষ্টুড়িয়া ফেলিয়া দিলেন, তাহা প্লাটফর্মের পাথরের মেজের উপর ছড়াইয়া পড়িয়া ঝনঝনি করিয়া বাজিয়া উঠিল। স্টেশনমাস্টার অত্যন্ত সংকুচিত হইয়া চলিয়া গেল-টাকা বঁচাইরার জন্য পিতা যে মিথ্যা কথা বলিবেন, এ সন্দেহের ক্ষুদ্রতা তাহার মাথা ঠোঁট করিয়া দিল। । অমৃতসরে গুরুন্দরবার আমার স্বপ্নের মতো মনে পড়ে। অনেকদিন সকালবেলায় পিতৃদেবের সঙ্গে পদব্ৰজে সেইসরোবরের মাঝখানে শিখ-মন্দিরে গিয়াহি। সেখানে নিয়তই ভজনা চলিতেছে। আমার পিতা সেই শিখ উপাসকদের মাঝখানে বসিয়া সহসা একসময় সুর করিয়া তাহাদের ভজনায় যোগ দিতেন— । ১. তু পরে-প্রকাশিত রুদ্রচণ্ড নাটক, রবীন্দ্র-রচনাবলী-অ ১