পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

as রবীন্দ্র-রচনাবলী জায়গা পড়াইতে পড়াইতে ফ্র্যাঙ্কলিনের ঘোরতর সাংসারিক বিজ্ঞতার দৃষ্টান্তে ও উপদেশবাক্যে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিতেন এবং প্রতিবাদ না করিয়া থাকিতে পারিতেন না। ইহার পূর্বে মুগ্ধবােধ মুখস্থ করা ছাড়া সংস্কৃত পড়ার আর-কোনো চৰ্চা হয় নাই। পিতা আমাকে একেবারেই ঋজুপাঠ দ্বিতীয়ভাগ” পড়াইতে আরম্ভ করিলেন এবং তাহার সঙ্গে উপক্ৰমণিকার শব্দরূপ মুখস্থ করিতে দিলেন। বাংলা আমাদিগকে এমন করিয়া পড়িতে হইয়াছিল যে, তাহাতেই আমাদের সংস্কৃতশিক্ষার কাজ অনেকটা অগ্রসর হইয়া গিয়াছিল। একেবারে গোড়া হইতেই যথাসাধ্য সংস্কৃত রচনাকার্যে তিনি আমাকে উৎসাহিত করতেন। আমি যাহা পড়িতাম তাহারই শব্দগুলা উলটাপালট করিয়া লম্বা লম্বা সমাস গাথিয়া যেখানে-সেখানে যথেচ্ছ অনুস্বার যোগ করিয়া দেবভাষাকে অপদেবের যোগ্য করিয়া তুলিতাম। কিন্তু পিতা আমার এই অদ্ভুত দুঃসাহসকে একদিনও উপহাস করেন নাই। ইহা ছাড়া তিনি প্রকটরের লিখিত সরলপাঠ্য ইংরেজি জ্যোতিষগ্রন্থ হইতে অনেক বিষয় মুখে মুখে আমাকে বুঝাইয়া দিতেন ; আমি তাহা বাংলায় লিখিতাম।” - 萍 র্তাহার নিজের পড়ার জন্য তিনি যে বইগুলি সঙ্গে লইয়াছিলেন তাহার মধ্যে একটা আমার চোখে খুব ঠেকিত। দশ-বারো খণ্ডে বঁধানো বৃহদাকার গিবনের রোম।” দেখিয়া মনে হইত না ইহার মধ্যে কিছুমাত্র রস আছে। আমি মনে ভাবিতম, আমাকে দায়ে পড়িয়া অনেক জিনিস পড়িতে হয়, কারণ আমি বালক, আমার উপায় নাই- কিন্তু ইনি তো ইচ্ছা করিলেই না পড়িলেই পারিতেন, তবে এ দুঃখ কেন। অমৃতসরে মাসখানেক ছিলাম। সেখান হইতে চৈত্রমাসের শেষে ডালহােঁসি পাহাড়ে যাত্রা করা গেল। অমৃতসরে মাস আর কাটিতেছিল না। হিমালয়ের আহ্বান আমাকে অস্থির করিয়া তুলিতেছিল। যখন ঝাপানে করিয়া পাহাড়ে উঠতেছিলাম তখন পর্বতে উপত্যকা-আধিত্যকদেশে নানাবিধ চৈতালি ফসলে স্তরে স্তরে পঙক্তিতে পাণ্ডুক্তিতে সৌন্দর্যের আগুন লাগিয়া গিয়াছিল। আমরা প্রাতঃকালেই দুধ রুটি খাইয়া বাহির হইতাম এবং অপরান্ত্রে ডাকবাংলায় আশ্ৰয় লাইতাম। সমস্তদিন আমার দুই চােখের বিরাম ছিল না- পাছে কিছু একটা এড়াইয়া যায়, এই আমার ভয় । যেখানে পাহাড়ের কোনো কোণে পথের কোনাে বীকে পল্লবভারাচ্ছন্ন বনস্পতির দল নিবিড় ছায়া রচনা করিয়া দাঁড়াইয়া আছে এবং ধ্যানরত বৃদ্ধ তপস্বীদের কোলের কাছে লীলাময়ী মুনিকন্যাদের মতো দুই-একটি ঝরনার ধারা সেই ছায়াতল দিয়া, শৈবালাচ্ছন্নকালো পাথরগুলার গা বাহিয়া, ঘনশীতল অন্ধকারের নিভৃত নেপথ্য হইতে কুলকুল করিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে, সেখানে ঝাপানির বঁাপান নামাইয়া বিশ্রাম করিত। আমি লুব্ধভাবে মনে করিতাম, এ-সমস্ত জায়গা আমাদিগকে ছাড়িয়া যাইতে হইতেছে কেন । এইখানে থাকিলেই তো হয়। নূতন পরিচয়ের ঐ একটা মন্ত সুবিধা। মন তখনো জানিতে পারে না যে এমন আরো অনেক আছে। তাহা জানিতে পারিলেই হিসাবি মন মনোযোগের খরচটা বঁাচাইতে চেষ্টা করে। যখন প্রত্যেক জিনিসটাকেই একান্ত দুর্লভ বলিয়া মনে করে তখনই মন আপনার কৃপণতা ঘুচাইয়া পূর্ণ মূল্য দেয়। তাই আমি এক-একদিন কলিকাতার রান্তা দিয়া যাইতে যাইতে নিজেকে বিদেশী বলিয়া কল্পনা করি। তখনই বুঝিতে পারি, দেখিবার জিনিস ঢের আছে, কেবল মন দিবার মূল্য দিই না বলিয়া দেখিতে পাই না। এই কারণেই দেখিবার ক্ষুধা মিটাইবার জন্য লোকে বিদেশে যায়। আমার কাছে পিতা তাহার ছোটাে ক্যাশবাজটি রাখিবার ভার দিয়াছিলেন। এ সম্বন্ধে আমিই যোগ্যতম ব্যক্তি, সে কথা মনে করিবার হেতু ছিল না। পথখরচের জন্য তাঁহাতে অনেক টাকাই থাকিত। কিশোরী ১ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর -প্ৰণীত & Richd. A. Proctor ৩ “রবীন্দ্র এখানে ভালো আছে এবং আমার নিকট সংস্কৃত ও ইংরেজি অল্প অল্প পাঠ শিখিতেছে। ইহাকে ব্ৰাহ্মধর্মও পড়াইয়া থাকি।”-দেবেন্ত্রনাথের পত্র, বক্রেটা, ২৫ এপ্রিল ১৮৭৩ 8 The History of the Decline and Fall of the Roman Empire by Edward Gibbon (1838 ed.)