পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

80 রবীন্দ্র-রচনাবলী মধুসূদন তাহার দর্পহারিত্বের একটু আভাসমােত্ৰ দিয়া আমাকে এ যাত্রা ছাড়িয়া দিলেন। বড়দাদা বােধ হয় কোনো একটা রচনায় নিযুক্ত ছিলেন- বাংলা ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য তিনি কোনো আগ্ৰহ প্ৰকাশ করিলেন না । গুটিকয়েক লোক শুনিয়াই ‘বেশি হইয়াহে বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন। ইহার পর ইস্কুলে যাওয়া আমার পক্ষে পূর্কের চেয়ে আরো অনেক কঠিন হইয়া উঠিল। নানা ছল করিয়া বেঙ্গল একাডেমি হইতে পলাইতে শুরু করলাম। সেণ্টজেবিয়ার্সে আমাদের ভরতি করিয়া দেওয়া হইল।” সেখানেও কোনো ফল হইল না । দাদারা মাঝে মাঝে এক-আধবার চেষ্টা করিয়া আমার আশা একেবারে ত্যাগ করিলেন। আমাকে ভৎসনা করাও ছাড়িয়া দিলেন। একদিন বড়দিদি কহিলেন, “আমরা সকলেই আশা করিয়ছিলাম বড়ো হইলে রবি মানুষের মতো হইবে কিন্তু তাহার আশাই সকলের চেয়ে নষ্ট হইয়া গেল।” আমি বেশ বুঝিতাম। ভদ্রসমাজের বাজারে আমার দর কমিয়া যাইতেছে কিন্তু তবু যে বিদ্যালয় চারিদিকের জীবন ও সৌন্দর্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন জেলখানা ও হাসপাতাল-জাতীয় একটা নির্মম বিভীষিকা, তাহার নিত্য আবর্তিত ঘানির সঙ্গে কোনোমতেই আপনাকে জুড়িতে পরিলাম না। সেন্টজেবিয়ার্সের একটি পবিত্ৰীস্মৃতি আজ পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে আন্নান হইয়া রহিয়াছে- তাহা সেখানকার অধ্যাপকদের স্মৃতি। আমাদের সকল অধ্যাপক সমান ছিলেন না, বিশেষভাবে যে দুই-একজন আমার ক্লাসের শিক্ষক ছিলেন ঠাহীদের মধ্যে ভগবদভক্তির গভীর নম্ৰতা আমি উপলব্ধি করি নাই। বরঞ্চ সাধারণত শিক্ষকেরা যেমন শিক্ষাদানের কােল হইয়া উঠিয়া বালকদিগকে হৃদয়ের দিকে পীড়িত করিয়া থাকেন, তাহারা তাহার চেয়ে বেশি উপরে উঠতে পারেন নাই। একে তো শিক্ষার কল একটা মস্ত কল, তাহার উপরে মানুষের হৃদয়প্রকৃতিকে শুষ্ক করিয়া পিষিয়া ফেলিবার পক্ষে ধর্মের বাহ্য অনুষ্ঠানের মতো এমন জাতা জগতে আর নাই। যাহারা ধর্মসাধনার সেই বাহিরের দিকেই অটকা পড়িয়াছে তাহারা যদি আবার শিক্ষকতার কলের ঢাকায় প্রত্যহ পাক খাইতে থাকে, তবে উপাদেয় জিনিস তৈরি হয় না- আমার শিক্ষকদের মধ্যে সেইপ্রকার দুইকলে-ইটা নমুনা বোধ করি ছিল। কিন্তু তবু সেন্টজেবিয়ার্সের সমস্ত অধ্যাপকদের জীবনের আদর্শক উচ্চকরিয়া ধরিয়া মনের মধ্যে বিরাজ করিতেছে, এমন একটি স্মৃতি আমার আছে। ফাদার ডি পেনেরান্ডার” সহিত আমাদের যোগ তেমন বেশি ছিল না- বোধ করি কিছুদিন তিনি আমাদের নিয়মিত শিক্ষকের বদলিরূপে কাজ করিয়াছিলেন। তিনি জাতিতে স্পেনীয় ছিলেন। ইংরেজি উচ্চারণে র্তাহার যথেষ্ট বাধা ছিল। বোধ করি সেই কারণে র্তাহার ক্লাসের শিক্ষায় ছাত্ৰগণ যথেষ্ট মনোযোগ করিত না। আমার বোধ হইত, ছাত্রদের সেই ঔদাসীন্যের ব্যাঘাত তিনি মনের মধ্যে অনুভব করিতেন। কিন্তু নম্রভাবে প্রতিদিন তাহ সহ্য করিয়া লইতেন। আমি জানি না কেন,তাহার জন্য আমার মনের মধ্যে একটা বেদনা বোধ হইত। তােহর মুখশ্ৰী সুন্দর ছিল না। কিন্তু আমার কাছে তাহার কেমন একটি আকর্ষণ ছিল । তঁহকে দেখিলেই মনে হইত, তিনি সর্বদাই আপনার মধ্যে যেন একটি দেবোপাসনা বহন করিতেছেনঅন্তরের বৃহৎ এবং নিবিড় স্তৱতায় ঠাঁহাকে যেন আবৃত করিয়া রাখিয়ছে। আধঘণ্টা আমাদের কপি লিখিবার সময় ছিল- আমি তখন কলম হাতে লইয়া অন্যমনস্ক হইয়া যাহা তাহা ভাবিতোম। একদিন ফাদার ডি পেনেরাভা এই ক্লাসের অধ্যক্ষতা করিতেছিলেন। তিনি প্রত্যেক বেঞ্চির পিছনে পদচারণা করিয়া যাইতেছিলেন। বোধ করি তিনি দুই-তিনবার লক্ষ্য করিয়ছিলেন, আমার কলম সরিতেছে না। এক সময়ে আমার পিছনে থামিয়া দাড়াইয়া নত হইয়া আমার পিঠে তিনি হাত রাখিলেন এবং অত্যন্তু সস্নেহশ্বরে আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “টাগোর, তোমার কি শরীর ভালো নাই।"- বিশেষ কিছুই নহে। কিন্তু আঞ্জ পর্যন্ত র্তাহার সেই প্রশ্নটি ভুলি নাই। অন্য ছাত্রদের কথা বলতে পারি না। কিন্তু আমি ঠাঁহার ভিতরকার e vras (), RUMATEM YAW () ২ সৌদামিনী দেবী (১৮৪৭-১১২০) e De Penaranda