পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88 রবীন্দ্র-রচনাবলী তাকাইয়া থার্কিতাম। মাঝখানে ব্যবধােন যদিও বেশি ছিল না, তবু সে আমার শিশুজগৎ হইতে বহুদূরের আলো। আমার খুড়তুত ভাই গণেন্দ্ৰদাদা” তখন রামনারায়ণ তর্করত্নকে দিয়া নবনাটক লিখাইয়া বাড়িতে তাহার অভিনয় করাইতেছেন। সাহিত্য এবং ললিতকলায় তাহদের উৎসাহের সীমা ছিল না। বাংলার আধুনিক যুগকে যেন ঠাহারা সকল দিক দিয়াই উদবোধিত করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। বেশ-ভূষায় আদর্শ জাগিয়া উঠিতেছিল। পৃথিবীর সকল দেশের ইতিহাসচর্চায় গণদাদার অসাধারণ অনুরাগ ছিল। অনেক ইতিহাস তিনি বাংলায় লিখিতে আরম্ভ করিয়া অসমাপ্ত রাখিয়া গিয়াছেন। তঁহার রচিত বিক্রমোর্কশী” নাটকের একটি অনুবাদ অনেকদিন হইল ছাপা হইয়াছিল। তঁহার রচিত ব্ৰহ্মসংগীতগুলি এখনো ধর্মসংগীতের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করিয়া আছে। গাও হের্তাহার নাম রচিত যার বিশ্বধাম, দয়ার ধারনাহি বিরাম ঝরে অবিরত ধাঁৱে বিখ্যাত গানটি ঠাঁহারই। বাংলায় দেশানুরাগের গান ও কবিতার প্রথম সূত্রপাত ঠাহারাই করিয়া গিয়াছেন সে আজ কতদিনের কথা যখন গণদাদার রচিত ‘লজ্জায় ভারতযশ গাঁহিব কী করে গানটি হিন্দুমেলায় গাওয়া হইত। যুবাবয়সেই গণদাদার যখন মৃত্যু হয় তখন আমার বয়স নিতান্ত অল্প। কিন্তু তাহার সেই সৌম্যগাষ্ঠীর উন্নত গীেরকান্ত দেহ একবার দেখিলে আর ভুলিবার জো থাকে না। তঁহার ভারি একটা প্রভাব ছিল। সে-প্রভাবটি সামাজিক প্রভাব। তিনি আপনার চারি দিকের সকলকে টানিতে পারিতেন, বাধিতে পারিতেন- তাহার আকর্ষণের জোরে সংসারের কিছুই যেন ভাঙিয়াচুরিয়া বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়িতে পারিত না । আমাদের দেশে এক-একজন এইরকম মানুষ দেখিতে পাওয়া যায়। তাহারা চরিত্রের একটি বিশেষ শক্তিপ্রভাবে সমস্ত পরিবারের অথবা প্রামের কেন্দ্ৰন্থলে অনায়াসে অধিষ্ঠিত হইয়া থাকেন। ইহারাই যদি এমন দেশে জন্মিতেন যেখানে রাষ্ট্ৰীয় ব্যাপারে বাণিজ্যব্যবসায়ে ও নানাবিধ সৰ্বজনীন কর্মে সর্বদাই বড়ে বড়ো দল বাধা চলিতেছে তবে ইহারা স্বভাবতই গণনায়ক হইয়া উঠিতে পারিতেন। বহুমানবকে মিলাইয় এক-একটি প্রতিষ্ঠান রচনা করিয়া তোলা বিশেষ একপ্রকার প্রতিভার কাজ ! আমাদের দেশে সেই প্রতিভা কেবল এক-একটি বড়ো বড়ো পরিবারের মধ্যে অখ্যাত ভাবে আপনার কাজ করিয়া বিলুপ্ত হইয়া যায়। আমার মনে হয়, এমন করিয়া শক্তির বিস্তর অপব্যয় ঘটে- এ যেন জ্যোতিষ্ক লোক হইতে নক্ষত্ৰকে পাড়িয়া তাহার দ্বারা দেশলাইকাঠির কাজ উদ্ধার করিয়া লওয়া । ইহার কনিষ্ঠ ভাই গুণদাদাকে বেশ মনে পড়ে। তিনিও বাড়িটিকে একেবারে পূর্ণ করিয়া রাখিয়ছিলেন। আত্মীয়বন্ধু আশ্ৰিত অনুগত অতিথি অভ্যাগতকে তিনি আপনার বিপুল ওদার্থের দ্বারা বেষ্টন করিয়া ধরিয়াছিলেন। তঁহর দক্ষিণের বরাদ্দায়, তাহার দক্ষিণের বাগানে, পুকুরের বাধা ঘাটে মাছ ধরিবার সভায়, তিনি মূর্তিমান দক্ষিণের মতো বিরাজ করতেন। সৌন্দর্যবােধ ও গুণগ্ৰাহিতায় তাহার নধর শরীর-মনটি যেন ঢলঢল করিতে থাকিত। নাট্যকীেতুক আমোদ-উৎসবের নানা সংকল্প ঠাঁহাকে আশ্রয় করিয়া নব নব বিকাশলাভের চেষ্টা করিত। শৈশবের অনধিকারবশত তাহদের সে সমস্ত উদযোগের মধ্যে আমরা সকল সময়ে প্রবেশ করিতে পাইতাম না- কিন্তু উৎসাহের ঢেউ চারি দিক হইতে আসিয়া আমাদের ঔৎসুকোর উপরে কেবলই ঘা দিতে থার্কিত। বেশ মনে পড়ে, বড়দাদা একবার কী-একটা কিস্তৃত কৌতুকনােটা (Burlesque) রচনা করিয়াছিলেন- প্রতিদিন মধ্যাহ্নে গুণদাদার বড়ো বৈঠকখানাঘরে তাহার রিহার্সাল ১ গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪১-৬৯), দেবেন্দ্রনাথের অনুজগিরীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠপুত্ৰ ২রচনা মে ১৮৬৬; প্রথম অভিনয় ৫ জানুয়ারি, ১৮৬৭ eevrose (over)