পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

7q eee বস্তুত পরমাত্মাকে এই আত্মার মধ্যে দেখার জন্যই মানুষের চিত্ত অপেক্ষা করিতেছে। কেননা আত্মার । সঙ্গেই আত্মার স্বাভাবিক যোগ সকলের চেয়ে সত্য; সেইখনেই মানুষের গভীরতম মিল। আর সর্বত্র । নানাপ্রকার বাধা। বাহিরের আচার বিচার-অনুষ্ঠান কল্পনাকাহিনীতে পরস্পরের মধ্যে পার্থক্যের অন্ত নাই ; কিন্তু মানুষের আত্মীয় আত্মীয় এক হইয়া আছে- সেইখনেই যখন পরমাত্মাকে দেখি তখন সমস্ত মানবাত্মার মধ্যে তঁহকে দেখি, কোনো বিশেষ জাতিকুল সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখি না। সেইজন্যই আজ উৎসবের দিনে সেই রসম্বরূপের নিকট আমাদের যে প্রার্থনা তাহা ব্যক্তিগত প্রার্থনা নহে, তাহা আমাদের আত্মার প্রার্থনা, অর্থাৎ তাহা একই কালে সমস্ত মানবাত্মার প্রার্থনা । হে বিশ্বমানবের দেবতা, হে বিশ্বসমাজের বিধাতা, এ কথা যেন আমরা একদিনের জন্যও না ভুলি যে, আমার পূজা সমস্ত মানুষের পূজারই অঙ্গ, আমার হৃদয়ের নৈবেদ্য সমস্ত মানবহৃদয়ের নৈবেদেরই একটি অর্ঘ্য । হে অন্তর্যামী, আমার অন্তরের বাহিরের, আমার গোচর অগোচর যত৷-কিছু পাপ যত৷-কিছু অপরাধ এই কারণেই অসহ্য যে আমি তাহার দ্বারা সমস্ত মানুষকেই বঞ্চনা করিতেছি, আমার সে সকল বন্ধন সমস্ত মানুষেরই মুক্তির অন্তরায়, আমার নিজের নিজত্বের চেয়ে যে বড়ো মহত্ত্ব আমার উপর তুমি অর্পণ করিয়াছ আমার সমস্ত পাপ তাহাকেই স্পর্শ করিতেছে ; এইজন্যই পাপ এত নিদারুণ, এত ঘূণ্য ; তাহাকে আমরা যত গোপনই করি তাহা গোপনের নহে, কোন একটি সুগভীর যোগের ভিতর দিয়া তাহা সমস্ত মানুষকে গিয়া আঘাত করিতেছে, সমস্ত মানুষের তপস্যাকেই স্নান করিয়া দিতেছে। হে ধৰ্মরাজ, নিজের যতটুকু সাধ্য তাহার দ্বারা সর্বমানবের ধর্মকে উজ্জ্বল করিতে হইবে, বন্ধনকে মোচন করিতে হইবে, সংশয়কে দূর করিতে হইবে। মানবের অন্তরাত্মার অন্তৰ্গঢ় এই চিরসংকল্পটিকে তুমি বীর্যের দ্বারা প্রবল করো, পুণ্যের দ্বারা নির্মল করো, তাহার চারিদিক হইতে সমস্ত ভয়সংকোচের জাল ছিন্ন করিয়া দাও, তাহার সম্মুখ হইতে সমস্ত স্বার্থের বিয়া ভগ্ন করিয়া দাও । এ যুগ, সমস্ত মানুষে মানুষে কঁধে কাধে মিলাইয়া হাতে হাতে ধরিয়া, যাত্রা করিবার যুগ। তোমার হুকুম আসিয়াছে চলিতে হইবে। আর একটুও বিলম্ব না। অনেকদিন মানুষের ধর্মবােধ নানা বন্ধনে বন্ধ হইয়া নিশ্চল হইয়া পড়িয়ছিল। সেই ঘোর নিশ্চলতার রাত্রি আজ প্ৰভাত হইয়াছে। তাই আজ দশ দিকে তোমার আহ্বানভোয়ী বাজিয়া উঠিল। অনেকদিন বাতাস এমনি স্তব্ধ হইয়া ছিল যে মনে হইয়াছিল সমস্ত আকাশ যেন মূৰ্ছিত ; গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ে নাই, ঘাসের আগাটি পর্যন্ত কঁপে নাই-আজ ঝড় আসিয়া পড়িল ; আজ শুষ্ক পাতা উড়িবে, আজ সঞ্চিত ধূলি দূর হইয়া যাইবে। আজ অনেকদিনের অনেক প্ৰিয়বন্ধনপাশ ছিন্ন হইবে সেজন্য মন কুষ্ঠিত না হউক । ঘরের, সমাজের, দেশের যে-সমস্ত বেড়া-আড়ালগুলাকেই মুক্তির চেয়ে বেশি আপনি বলিয়া তাহাদিগকে লইয়া অহংকার করিয়া আসিয়াছি সে-সমস্তকে ঝড়ের মুখের খড়কুটার মতো শূন্যে বিসর্জন দিতে হইবে সেজন্য মন প্রস্তুত হউক! : সত্যের ছদ্মবেশপরা প্ৰবল অসত্যের সঙ্গে, ধর্মের উপাধিধারী প্ৰাচীন অমঙ্গলের সঙ্গে আজ লড়াই করিতে হইবে, সেজন্য মনের সমস্ত শক্তি পূর্ণবেগে জাগ্ৰত হউক। আজ বেদনার দিন আসিল, কেননা আজ চেতনার দিন- সেজন্য আজ কাপুরুষের মতো নিরানন্দ হইলে চলিবে না ; আজ ত্যাগের দিন আসিল, কেননা আজ চলিবার দিন, আজ কেবলই পিছনের দিকে তাকাইয়া বসিয়া থাকিলে দিন বহিয়া । যাইবে, আজ কৃপণের মতো রুদ্ধ সঞ্চায়ের উপর বুক দিয়া পড়িয়া থাকিলে ঐশ্বর্যের অধিকার হারাইতে থাকিব। ভীরু, আজ লোকভয়কেই ধর্মভয়ের স্থানে যদি বরণ কর তবে এমন মহাদিন ব্যর্থ হইবেআজ নিন্দাকেই ভূষণ, আজ অপ্রিয়কেই প্রিয় করিয়া তুলিতে হইবে। আজ অনেক খসিবে, ঝরিবে, ভাঙিবে, ক্ষয় হইয়া যাইবে- নিশ্চয় মনে করিয়ছিলাম যেদিকে পর্দা সেদিকে হঠাৎ আলোক প্রকাশ হইবে ; নিশ্চয় মনে করিয়ছিলাম যেদিকে প্রাচীর সেদিকে হঠাৎ পথ বাহির হইয়া পড়িবে। হে । যুগান্তবিধাতা, আজ তোমার প্রলয়লীলায় ক্ষণে ক্ষণে দিগন্তপট বিদীর্ণ করিয়া কতই অভাবনীয় প্রকাশ অতলস্পর্শ রহস্য আজ উন্মথিত হইয়া জ্ঞানে কর্মে ত্যাগে ধর্মে কত কত অত্যাশ্চর্য অজেয় শক্তি