পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

e88 রবীন্দ্ররচনাবলী করিয়া ছাড়িবে ? প্রয়োজন থােক। আর নাই থােক। অগ্নি তাহার তাপধর্মকে ছাড়িতে পারে না, কারণ তাঁহাই তাহার স্বভাব। বাহির হইতে দেখিলে বলা যায় অগ্নিকাষ্ঠীকে চাহিতেছে কিন্তু ভিতরের সত্য কথা এই যে, অগ্নি আপনি স্বভাবকে সার্থক করিতে চাহিতেছে- সে জ্বলিতে চায় ইহাই তার স্বভাব- এইজন্য কখনো কাঠ, কখনো খড়, কখনো আয়-কিছুকে সে আত্মসাৎ করিতেছে ; সেদিক দিয়া তাহার উপকরণের তালিকার অন্ত পাওয়া যায় না। কিন্তু মূল কথাটি এই যে, সে আপনার স্বভাবকেই পূৰ্ণ করিতে চাহিতেছে। যখন তাহার উজ্জ্বল শিখাটি দেখা যায় না কেবল কৃষ্ণবর্ণ ধূমই উঠিতে থাকে, তখন সেই চাওয়া তাহার মধ্যে আছে; যখন সে ভস্মাচ্ছন্ন হইয়া বিলুপ্তপ্রায় হইয়া থাকে তখনাে সেই চাওয়া তাহার মধ্যে নির্বাপিত হয় না। কারণ তাহাই তাহার ধর্ম। মানুষেরও সকলের চেয়ে বড়ো চাওয়াটি তাহার ধর্ম। ইহাই তাহার। আপনাকে পরম আপনের মধ্যে চাওয়া । অন্য সকল চাওয়ার হিসাব দেওয়া যায়, কারণ তাহার হিসাব বাহিরে, কিন্তু এ চাওয়াটির হিসাব দেওয়া যায় না, কারণ ইহার হিসাব তাহার। আপনারই মধ্যে। এইজন্য তর্কে ইহাকে অস্বীকার করা অত্যন্ত সহজ কিন্তু মূলে ইহাকে অস্বীকার করা একেবারে অসম্ভব। এইজনাই শাস্ত্রে বলে, ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াম। এ তত্ত্ব বাহিরে নাই, এ তত্ত্ব অন্তরের মধ্যে সকলের মূলে নিহিত। সেইজন্য আমাদের তর্কবিতর্কের উপর, স্বীকার-অস্বীকারের উপর ইহার নির্ভর নহে। ইহা আছেই। মানুষের একটা প্রয়োজন আজমিটিতেছে, আর-একটা প্রয়োজন কালমিটিতেছে, যেটা মিটিতেছে সেটা চুকিয়া যাইতেছেকিন্তু তাহার স্বভাবের চরম চেষ্টা রহিয়াছেই । অবশ্য এ প্রশ্ন মনে উদয় হওয়া অসম্ভব নয় যে, ইহাই যদি মানুষের স্বভাব হয় তবে ইহার বিপরীত আমরা মনুষ্যসমাজে দেখি কেন ? চলিবার চেষ্টাই শিশুর পক্ষে স্বাভাবিক, তবু তো দেখি শিশু চলিতে পারে না। সে বারংবার পড়িয়া যায়। কিন্তু এই অক্ষমতা হইতে এই পড়িয়া যাওয়া হইতেই আমরা তাহার স্বভাব বিচার করি না। বরঞ্চ এই কথাই আমরা বলি যে, শিশু যে বারবার করিয়া পড়িতেছে আঘাত পাইতেছে তবু চলিবার চেষ্টা ত্যাগ করিতেছে নাইহার কারণ চলাই তাহার স্বভাব- সেই স্বভাবের প্রেরণাতেই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে, সমস্ত আত্মবিরোধের মধ্যে তাহার চলার চেষ্টা রহিয়া গিয়াছে। শিশু যখন মাটিতে গড়াইতেছে, যখন পৃথিবীর আকর্ষণ কেবলই তাহাকে নীচে টানিয়া টানিয়া, ফেলিতেছে তখনো তাহার স্বভাব এই প্রকৃতির আকর্ষণকে কাটাইয়া উঠিতে চাহিতেছে- সে আপনার শরীরের সম্পূর্ণ প্রভুত্ব চায়-টলিয়া টলিয়া পড়িতে চায় না ; ইহা তাহার পক্ষে প্রাকৃতিক নহে, ইহা তাহার পক্ষে স্বাভাবিক। এইজন্য প্রকৃতি যখন তাহাকে ধুলায় টানিয়া ফেলিতে চায় তখন তাহার স্বভাব তাহাকে উপরে টানিয়া রাখিতে চাহে। সমস্ত টলিয়া পড়ার মধ্যে এই স্বভাব তাঁহাকে কিছুতেই ছাড়ে না। আমাদের ধর্ম আমাদের সেইরূপ স্বভাব। প্রকৃতির উপরে সকল দিক হইতে আমাদিগকে খাড়া করিয়া তুলিবার জন্য সে কেবলই চেষ্টা করিতেছে- যখন ধুলায় লুটাইয়া তাহাকে অস্বীকার করিতেছি তখনো অন্তরের মধ্যে সে আছে। সে বলিতেছে আপনার স্থিতিকে পাইতেই হইবে, তাহা হইলেই গতিকে পাইবেদাঁড়াইতে পারলেই চলিতে পারবে। আপনাকে পাইলেই সমস্তকে মূলে গিয়া পাইবে। তখন তােমার সমস্ত জীবন প্রাকৃতিক হইবে না, স্বাভাবিক হইবে। স্বভাবে যখন তুমি প্রতিষ্ঠিত হইবে প্রকৃতি তখন তোমার অনুগত হইবে। তখনই তোমার ধর্ম সার্থক হইবে- তখনই তুমি তোমার চরিতার্থতাকে পাইবে। এই চরিতার্থতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করিয়া মানুষ বাহির হইতে যাহা কিছু পাইতেছে তাহাতেই তাহার অন্তরতম ইচ্ছা মাথা নাড়িয়া বলিতেছে- যেনাহং নােমৃতস্যাম কিমহং তেন। কুর্যম। এই চরিতার্থতা হইতে, এই পরিসমাপ্তি হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া সে যাহা-কিছু দেখিতেছে তাহার মধ্যে সে মৃত্যুকেই দেখিতেছে- কেবল বিচ্ছেদ, কেবল অবসান ; প্রয়োজন আছে তাহার আয়োজন পাই না, আয়োজন আছে তাহার প্রয়োজন চলিয়া যায়। এ যে মৃত্যুকে দেখা,ইহার অর্থ নিরর্থকতাকে দেখা। মানুষইচ্ছা করিল, কাজ করিল, সুখ দুঃখ ভোগ করিল, তাহার পর মরিয়া গেল। সেইখানে মৃত্যুকে যখন দেখি তখন মানুষের জীবনের সমস্ত ইচ্ছা! সমস্ত কাজের অর্থকে আর দেখিতে পাই না। তাহার দীর্ঘকালের জীবন মুহূর্তকালে মৃত্যুর মধ্যে হঠাৎ মিথ্যা হইয়া গেল । । পদে পদে এই মৃত্যুকে দেখা, এই অর্থহীনতাকে দেখা তো কখনোই সত্য দেখা নহে। অৰ্থাৎ ইহা কেশ। বাহিরের দেখা ; ভিতরের দেখা নহে ; ইহাই যদি সত্য হইত। তবে মিথ্যাই সত্য হইত- তাহা কখনো