পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সঞ্চয় । cesa অতি-নির্দিষ্টতার যে সাংঘাতিক অকল্যাণ তাহা স্বীকার করা ব্ৰাহ্মসমাজের পক্ষে প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ব্ৰাহ্মধর্মের ভিতরকার এই অনির্দিষ্টতাকে যথাসম্ভব দূর করিয়া তাহাকে এক জায়গায় চিরন্তনরপে স্থির রাখিবার জন্য আজকাল ব্ৰাহ্মসমাজের কেহ কেহ ব্ৰাহ্মধর্মকে একটি ধর্মতত্ত্ব একটি বিশেষ ফিলজফি বলিতে ইচ্ছা করেন । ইহার মধ্যে কতটুকু দ্বৈত, কতটুকু অদ্বৈত, কতটুকু দ্বৈতাদ্বৈত ; ইহার মধ্যে শংকরের প্রভাব কতটা, কতটা কান্টের, কতটা হেগেল বা গ্ৰীনের তাহা একেবারে পাকা করিয়া একটা কোনাে বিশেষ তত্ত্বকেই চিরকালের মতো ব্ৰাহ্মধর্মনাম দিয়া সমাপ্ত করিয়া দিবার জন্য র্তাহারা উদ্যত হইয়াছেন। বস্তুত ব্ৰাহ্মসমাজের প্রতি র্যাহাদের শ্রদ্ধা নাই তাহারা অনেকেই এই কথা বলিয়াই ব্ৰাহ্মধর্মকে নিন্দা করিয়াছেন যে উহা ধৰ্মই নহে উহা একটা ফিলজফি মাত্র ; ইহারা সেই কলঙ্ককেই গীেরব বলিয়া বরণ করিয়া লইতে চাহেন। অথচ ইহা আমরা স্পষ্টই প্রত্যক্ষ করিয়াছি যে, ব্ৰাহ্মধর্ম অন্যান্য বিশ্বজনীন ধর্মেরই ন্যায়। ভক্তের জীবনকে আশ্রয় করিয়াই ইতিহাসে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহা কোনো ধর্মবিদ্যালয়ের টেকস্টবুক-কমিটির সংকলিত সামগ্ৰী নহে এবং ইহা গ্রন্থের পরিচ্ছেদে পরিচ্ছেদে পরিচ্ছিন্ন হইয়া কোনাে দপ্তরির হাতে মজবুত করিয়া বাধাই হইয়া যায় নাই । যাহা জীবনের সামগ্ৰী তাহা বাড়িবে, তাহা চলিবে । একটা পাথরকে দেখাইয়া বলিতে পার ইহাকে যেমনটি দেখিতেছ। ইহা তেমনই কিন্তু একটা বীজ সম্বন্ধে সে কথা খাটে না । তাহার মধ্যে এই একটি আশ্চর্য রহস্য আছে যে, সে যেমনটি সে তাহার চেয়ে অনেক বড়ো। এই রহস্যকে যদি অনির্দিষ্টতা বলিয়া নিন্দা কর, তবে ইহাকে জাতীয় ফেলিয়া পেষো— ইহার জীবধর্মকে নষ্ট করিয়া ফেলো। কিন্তু যিনি যাহাই বলুন ব্ৰাহ্মধর্ম কোনো একটি বিশেষ নির্দিষ্ট সুপ্ৰণালীবদ্ধ তত্ত্ববিদ্যা নহে। কারণ, আমরা ইহাকে ভক্তের জীবন-উৎস হইতে উৎসারিত হইতে দেখিয়ছি। তাহা ডোবা নহে, বাধানো সরোবর নহে, তাহা কালের ক্ষেত্রে ধাবিত নদী- তাহার রূপ প্রবহমান রূপ, তাহা বাধাহীন বেগে নব নব যুগকে আপনি অমৃতধারা পান করাইয়া চলিবে- নব নব হেগেল ও গ্ৰীন তাহার মধ্যে নব নব পাথরের ঘাট বাধাইয়া দিতে থাকিবে, কিন্তু সে-সকল ঘটকেও তাঁহা বহুদূরে ছাড়াইয়া চলিবে- কোনো স্পর্ধিত তত্ত্বজ্ঞানীকে সে এমন কথা কদাচ বলিতে দিবে না যে ইহাই তাহার শেষ তত্ত্ব । কোনো দৰ্শনতত্ত্ব এই ধর্মকে একেবারে বাধিয়া ফেলিবার জন্য যদি ইহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ফাস লইয়া ছোটে তবে এ কথা তাহাকে মনে রাখিতে হইবে যে, যদি ইহাকে বন্দী করিতে হয় তবে তাহার আগে ইহাকে বধ করিতে হইবে। তাই যদি হইল। তবে ব্রাহ্মধর্মের ভাবাত্মক লক্ষণটি কী ? তাহা একটা মোটা কথা, তাহা অনন্তের ক্ষুধাবােধ, অনন্তের রসবােধ। এই অনন্তের জ্ঞানকে বিশ্লেষণ করিয়া যিনি যেরূপ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করুন তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই, কারণ এরূপ ব্যাখ্যা চিরকালই চলিবে, এ রহস্যের অন্ত পাওয়া যাইবে না ; কিন্তু আসল কথা এই যে রামমোহন রায় হইতে কেশবচন্দ্র সেন পর্যন্ত সকলেরই জীবনে আমরা এই অনন্তের ক্ষুধাবােধের আনন্দ প্রত্যক্ষ করিয়াছি। দেশের প্রচলিত আচার ও ধর্মবিশ্বাস যে তঁহাদের জ্ঞানকে আঘাত, দিয়াছে, তাহা নহে, তাহদের প্রাণকে আঘাত দিয়াছে। কিন্তু ব্ৰাহ্মধর্মকে কয়েকজন মানুষের জীবনের মধ্য দিয়া দেখিতে গেলেও তাঁহাকে ছোটাে করিয়া দেখা হইবে । বস্তুত ইহা মানব ইতিহাসের সামগ্ৰী। মানুষ আপনার গভীরতম অভাব মোচনের জন্য নিয়ত যে গুঢ় চেষ্টা করিতেছে ব্ৰাহ্মসমাজের সৃষ্টির মধ্যে আমরা তাহারই পরিচয় পাই। মানুষ যত বারই কৃত্রিম আচারপদ্ধতির দ্বারা অনন্তকে ছোটাে করিয়া আপনার সুবিধার মতো করিয়া লইতে চেষ্টা করিয়াছে ততবারই সে সোনা ফেলিয়া আঁচলে গ্রন্থি বাধিয়াছে। আমি একবার অত্যন্ত অদ্ভুত এই একটা স্বপ্ন দেখিয়ছিলাম যে, মা তাহার কোলের ছেলেটিকে সর্বত্র অতি সহজে বহন করিবার সুবিধা করিতে গিয়া তাহার মুণ্ডটা কাটিয়া লইয়াছিল। ইহা স্বপ্ন বটে কিন্তু মানুষ এমন কাজ করিয়া থাকে। আইডিয়াকে সহজসাধ্য করিবার জন্য সে তাহার মাথা কাটিয়া তাহাকে দিব্য সংক্ষিপ্ত করিয়া লয়, ইহাতে মুণ্ডটাকে করতলন্যন্ত আমলকবৎ আয়ত্ত করা যায় বটে। কিন্তু প্ৰাণটাকেই বাদ দিতে হয়। এমনি করিয়া মানুষ যেটাকে সব চেয়ে বেশি চায় সেইটে হইতেই আপনাকে সব চেয়ে বেশি ফাঁকি দিতে থাকে। এইরূপ অবস্থায় মানুষের মধ্যে দুই দল হইয়া পড়ে। এক দল আপনার সাধনার সামগ্ৰীকে খেলার সামগ্ৰী করিয়া সেই খেলােটাকেই সিদ্ধি মনে করে- আর-এক