পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

esv. রবীন্দ্র-রচনাবলী দল ইহাদের খেলার বিয়ানা করিয়া অতিদূরে নিভৃতে গিয়া আপনার সাধনার বিশুদ্ধতা রক্ষা করিবার চেষ্টা কিন্তু এমন করিয়া কখনোই চিরদিন চলে না। যখন চারি দিক অচেতন, সমস্ত দ্বার রুদ্ধ, সমস্ত দীপ নির্বাপিত, অভাব যখন এতই অধিক যে অভাববোধ চলিয়া গিয়াছে, বাধা। যখন এত নিবিড় যে মানুষ তাহাকে আপনার আশ্রয় বলিয়া অবলম্বন করিয়া ধরে, সেই সময়েই অভাবনীয়রূপে প্ৰতিকারের দূত কোথা হইতে দ্বারে আসিয়া দাঁড়ায় তাহা বুঝিতেই পারি না। তাহাকে কেহ প্রত্যাশা করে না, কেহ চিনে না, সকলেই তাহাকে শত্ৰু বলিয়া উদবিগ্ন হইয়া উঠে। এ দেশে একদিন যখন রাশীকৃত প্রাণহীন সংস্কারের বাধা অনন্তের বোধকে আচ্ছন্ন করিয়া ধরিয়াছিল, মানুষের জীবনযাত্রাকে তুচ্ছ ও সমাজকে শতখণ্ড করিয়া তুলিয়াছিল, মনুষ্যত্বকে যখন আমরা সংকীর্ণ গ্ৰাম্যতার মধ্যেই আবদ্ধ করিয়া দেখিতেছিলাম ; বিশ্বব্যাপারের কোথাও যখন আমরা একের অমোঘ নিয়ম দেখি নাই, কেবল দশের উৎপােতই কল্পনা করিতেছিলাম ; উন্মত্তের দুঃস্বপ্নের মতো যখন সমস্ত জগৎকে বিচিত্র বিভীষিকায় পরিপূর্ণ দেখিতেছিলাম এবং কেবলই মন্ত্রতন্ত্র তাগাতাবিজ শান্তিম্বন্ত্যয়ন মানত ও বলিদানের দ্বারা ভীষণ শত্রুকল্পিত সংসারে কোনোমতে আত্মরক্ষা করিয়া চলিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছিলাম; এইরূপে যখন চিন্তায় ভীরুতা, কর্মে দীেৰ্বল্য, ব্যবহারে সংকোচ এবং আচারে মুঢ়তা সমস্ত দেশের পীেরুষকে শতদীর্ণ করিয়া অপমানের রসাতলে আমাদিগকে আকর্ষণ করিতেছিল- সেই সময়ে বাহিরের বিশ্ব হইতে আমাদের জীর্ণ প্রাচীরের উপরে একটা প্ৰচণ্ড আঘাত লাগিল, সেই আঘাতে যাহারা জাগিয়া উঠিলেন তাহারা এক মুহুর্তেই নিদারুণ বেদনার সহিত বুঝিতে পরিলেন কিসের অভাব এখানে, কিসের এই অন্ধকার এই জড়তা এই অপমান, কিসের এই জীবিত-মৃত্যুর আনন্দহীন সর্বব্যাপী অবসাদ ! এখানে আকাশ খণ্ডিত ; আলোক নিষিদ্ধ, অনন্তের প্রাণসমীরণ প্ৰতিহত । এখানে নিখিলের সহিত অবাধ যোগ সহস্ৰ কৃত্রিমতার প্রাচীরে প্রতিরুদ্ধ। তঁহাদের সমস্ত প্ৰাণ কাদিয় जैठेिल, ठूभाक फ्रांड्ने, ठूभाक फाँश्। এই কান্নাই সমস্ত মানুষের কান্না। পৃথিবীর সর্বত্রই মানুষ কোথাও বা আপনার বহু প্রাচীন অভ্যাসের আবরণের দ্বারা আপনার মঙ্গলকে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে, কোথাও বা সে আপনার নানা রচনার দ্বার সঞ্চায়ের দ্বারা কেবলই আপনাকে বড়ো করিতে গিয়া আপনার চেয়ে বড়োকে হারাইয়া ফেলিতেছে কোথাও বা সে নিক্রিয়ভাবে জড়তার দ্বারা কোথাও বা সে সক্রিয়ভাবে প্ৰয়াসের দ্বারাই মানব-জীবনের শ্রেষ্ঠ সার্থকতাকে বিস্মৃত হইয়া বসিয়াছে। এই বিস্মৃতির গভীর তলদেশ হইতে আপনাকে উদ্ধার করিবার চেষ্টা,ইহাই আমরা ব্ৰাহ্মধর্মের ইতিহাসে: আরম্ভেই দেখিতে পাই। মানুষের সমস্ত বােধকেই অনন্তের বােধের মধ্যে উদবােধিত করিয়া তুলিবা? প্ৰয়াসই ব্ৰাহ্মধর্মের সাধনারূপে প্ৰকাশ পাইয়াছে। সেইজন্যই আমরা দেখিতে পাইলাম, রামমোহন রায়ে জীবনের কর্মক্ষেত্র সমস্ত মনুষ্যত্ব। রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি, সকল দিকেই তাহার চিত্ত পূর্ণবেগে ধাবিত হইয়াছে। কেবলমাত্র কর্মশক্তির স্বাভাবিক প্রাচুর্যই তােহর মূল প্রেরণা নহে- ব্ৰহ্মের বোধ তাহা সমস্ত শক্তিকে অধিকার করিয়াছিল। সেই বোধের মধ্য দিয়া তিনি মানুষকে দেখিয়ছিলেন বলিয়াই মানুষদে সকল দিকেই এমন বড়ো করিয়া এমন সত্য করিয়া দেখিয়ছিলেন ; সেইজন্যইষ্ঠাহীর দৃষ্টি সমস্ত সংস্কারে বেষ্টন ছাড়াইয়া গিয়াছিল; সেইজন্য কেবল যে তিনি স্বদেশের চিত্তশক্তির বন্ধনমােচন কামনা করিয়াছিলে তাহা নহে, মানুষ যেখানেই কোনো মহৎ অধিকার লাভ করিয়া আপনার মুক্তির ক্ষেত্রকে বড়ো করিতে পরিয়াছে সেইখনেই তিনি তৃপ্তিবােধ করিয়াছেন। ব্ৰাহ্মসমাজে, আরম্ভে এবং আজ পর্যন্ত এই সত্যকেই আমরা সকলের চেয়ে বড়ো করিয়া দেখিতেছি। কোনো বিশেষ শাস্ত্ৰ, বিশেষ মন্দির, বিশেষ দর্শনতত্ত্ব বা পূজাপদ্ধতি যদি এই মুক্ত সত্যের স্থান নিয়ে অধিকার করিয়া লইতে চেষ্টা করে তবে তাহা ব্ৰাহ্মধর্মের স্বভাববিরুদ্ধ হইবে। আমরা মানুষের জীবনে মধ্যেই এই সত্যকে নিশ্চিতরূপে প্রত্যক্ষ করিব যে, অনন্তবোধের আলোকে সমন্তকে দেখা এক অনন্তবোধের প্রেরণায় সমস্ত কাজ করা ইহাই মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ সিদ্ধি- ইহাই মানুষের সত্যধর্ম