পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

O * রবীন্দ্ৰ-য়চনাবলী অভ্যাসকে আমি আমার পরিপাকের সহায় বলিয়া কল্পনা করিয়া লইয়াহি কোনো দিন যদি তাহার অভাব ঘটে। তবে আমার নিজেরই মনে হইতে থাকে যে, আজ বুঝি পাকযন্ত্রটা তেমন বেশ উৎসাহের সহিত কাজ শুনা যায় কবিতা লিখিবার সময় বিখ্যাত জর্মন কৰি শিলার পটা,আপেল তঁহার ডেক্সের মধ্যে রাখিতেন। তঁহার পক্ষে ইহার উগ্ৰ গন্ধ হয়তো একটা উত্তেজনার কাজ করত। তঁহার শিষ্য যদি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিত আপনি কী করিয়া এমন ভালো কবিতা লেখেন। তবে তিনি আর-কোনো প্ৰকাশযোগ্য কারণ ঠাহর করিতে না পারিয়া ঐ পচা আপেলটাকেই হয়তো উপায় বলিয়া নির্দেশ করিতেও পারিতেন। এ স্থলে, তিনি যত বড়ো কবি হউন-না কেন, তাহার বাক্যকেই যে কবিত্ব চর্চার উপায় সম্বন্ধে বেদবাক্য বলিয়া গণ্য করিতে হইবে এমন কথা নাই। এরূপ স্থলে তঁহাকে যদি মুখের সামনে বলি তুমি কবিতাই লিখিতে পার তাই বলিয়া তাহার উপায় সম্বন্ধে কী জানি, তবে তঁহকে কবি হিসাবে অশ্রদ্ধা করা হয় না । বস্তুত স্বাভাবিক প্রতিভাবশতই যাহারা কোনো একটা জিনিস পায়, পাওয়ার প্রণালীটি তাহদেরই কাছে সব চেয়ে বেশি। বিলুপ্ত হইয়া থাকে। যেমন ব্যক্তিগত অভ্যাসের কথা বলিলাম। তেমনি এমন অনেক অভ্যাস আছে যাহা কৌলিক বা স্বাদেশিক । সেই সকল অভ্যাসমাত্রেই যে শক্তির সঞ্চার করে তাহা নহে ; এমন-কি, তাহারা শক্তিকে বহিরাশ্ৰিত করিয়া চিরদুর্বল করিয়া রাখে। অনেক মহাপুরুষ এইরূপ দেশপ্রচলিত অভ্যাসকে অমঙ্গলের হেতু বলিয়া আঘাত করিয়া থাকেন, আবার কেহ কেহ সংস্কারের প্রভাবে তাহার অবলম্বন ত্যাগ করেন নাই তাহাও দেখা যায়। শেষোক্ত সাধকেরা যে নিজের প্রতিভাগুণে এই সকল অভ্যাসের বাধা অতিক্রম করিয়াও আসল জায়গায় গিয়া পৌঁছিয়াছেন তাহা সকল সময়ে নিজেরাও বুঝেন না, এবং কখনো বা মনে করেন এখন আমার পক্ষে এই সকল বাহ্য প্রক্রিয়া বাহুল্য হইলেও গোড়ায় ইহার প্রয়োজন ছিল। ইহার ফল হয়। এই, যাহাদের স্বাভাবিক শক্তি নাই তাহারা কেবলমাত্র এই অভ্যাসগুলিকেই অবলম্বন করিয়া কল্পনা করে যে আমরা সার্থকতালাভ করিয়াছি; তাহারা অহংকৃত ও অসহিষ্ণু হইয়া উঠে এবং যেখানে তাঁহাদের অভ্যাসের সামগ্ৰী না দেখিতে পায় সেখানে যে সত্য আছে। এ কথা মনে করিতেই পারে না, কারণ তাঁহাদের কাছে এই সকল বাহ্য অভ্যাস এবং সত্য এক হইয়া গেছে। . যে সকল জিনিসের মূল কারণ বাহিরের অভ্যাস নহে, অন্তরের বিকাশ, তাহাদের সম্বন্ধে কোনাে কৃত্রিম প্ৰণালী থাকিতে পারে না, কিন্তু স্বাভাবিক। আমুকুল্য আছে। ধর্মবোধ জিনিসটাকে যদি আমরা কোনো একটা সাম্প্রদায়িক ফ্যাশান বা ভদ্রতার আসবাব বলিয়া গণ্য না করি, যদি তাহাকে মানুষের সর্বাঙ্গীণ চরম সার্থকতা বলিয়াই জানি, তবে প্রথম হইতেই বালকবালিকাদের মনকে ধর্মবোধে উদবােধিত করিয়া তুলিবার উপযুক্ত স্থান এবং অবকাশ থাকা আবশ্যক এ কথা আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে ; অর্থাৎ চারি দিকে সেই রকমের হাওয়া আলো আকাশটা থাকা চাই যাহাতে নিশ্বাস লাইতেই প্রাণসঞ্চার হয় এবং আপনা হইতেই চিত্ত বড়ো হইয়া উঠিতে থাকে। নিজের বাড়িতে যদি সেই অনুকুল অবস্থা পাওয়া যায়। তবে তো কথাই নাই। অর্থাৎ সেখানে বৈষয়িকতাই নিজের মূর্তিকে সকলের চেয়ে প্রবল করিয়া না বসিয়া থাকে, যদি অর্থই সেখানে পরমার্থনা হয়, যদি গৃহস্বামী নিজেকেই নিজের সংসারের স্বামী বলিয়া প্রতিষ্ঠিত না করিয়া থাকেন, যদি তিনি বিশ্বের মঙ্গলময় স্বামীকেই বাক্যে ও ব্যবহারে মানিয়া চলেন, যদি সকলপ্রকার সাময়িক ঘটনাকে নিজের রাগদ্বেষের নিক্তিতে তীেল না করিয়া, ভূমার মধ্যে স্থাপিত করিয়া যথাসাধ্য তাহাদিগকে বিচার ও যথোচিতভাবে তাহাদিগকে গ্রহণ করিতে চেষ্টা করেন, তবে সেইখানেই ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার স্থান বটে। এরূপ সুযোগ সকল ঘরে নাই সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ঘরে নাই। আর বাহিরে আছে। এ কথ বলিলেই বা চলিবে কেন ? এ সব দুর্লভ জিনিস তো আবশ্যক বুধিয়া ফরমাশ দিয়া তৈরি করা যায় না। সে কথা সত্য। কিন্তু আবশ্যকতা যদি থাকে এবং তাহার বোধ যদি জাগে তবে আপনিই যে সে আপনার পথ করিতে থাকিবে। সেই পথ করার কাজ আরম্ভ হইয়াছে ; আমরা ইচ্ছা করিতেছি, আমরা সন্ধান করিতেছি। আমরা চেষ্টা করিতেছি। আমরা যাহা চাই আমাদের মনের মধ্যে তাহার একটা আদর্শ দুরিয়া বেড়াইতেছে