পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

To জীবনের সাধনাকে, যদি আমরা কোনাে একটি বিশেষ অনুকুল স্থানে আকর্ষণ করিয়া আনিতে পারি, তাহা যদি স্থানে স্থানে বিক্ষিপ্ত হইয়াছড়াইয়া না থাকে। তবে এই পুঞ্জীভূত শক্তিকে আমরা মানব সমাজের উচ্চতম এ দেশে একদিন তপােবনের এইরূপ ব্যবহারই ছিল, সেখানে সাধনা ও শিক্ষা একত্র মিলিত হইয়াছিল বলিয়া, সেখানে পাওয়া এবং দেওয়ার কাজ অতি সহজে নিয়ত অনুষ্ঠিত হইতেছিল বলিয়াই তপোবন হৃৎপিণ্ডের মতো সমস্ত সমাজের মর্মস্থান অধিকার করিয়া তাহার প্রাণকে শোধন পরিচালন এবং রক্ষা করিয়াছে। বীেন্ধ বিহারেরও সেই কাজ ছিল। সেখানে পাওয়া এবং দেওয়া অবিচ্ছিন্ন হইয়া বিরাজ করিতেছিল । এইখানে স্বভাবতই শ্রোতাদের মনে এই প্রশ্ন উঠবে যে তবে পূর্বে যে আশ্রমটির কথা বলা হইয়াছে সেখানে কি সাধকদের সমাগমে একটি পরিপূর্ণ ধর্মজীবনের শতদল পদ্ম বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে ? না, তাহা হয় নাই। আমরা যাহারা সেখানে সমবেত হইয়াছি আমাদের লক্ষ্য এক নহে এবং তােহা যে নির্বিশেষে উচ্চ এমন কথাও বলিতে পারিনা। আমাদের সকলেরই শ্রদ্ধা যে গভীর এবং ধ্রুব তাহানহে এবং তাহা আশাও করি না। আমরা যাহাকে উচ্চাকাঙক্ষা নাম দিয়া থাকি অর্থাৎ সাংসারিক উন্নতি ও খ্যাতিপুতিগতির ইচ্ছা, তাহা আমাদের মনে খুবই উচ্চ হইয়া আছে, সকলের চেয়ে উচ্চ আকাঙ্ক্ষাকে উচ্চে স্থাপন করিতে পারি নাই। কিন্তু তৎসত্বেও এ কথা আমি দৃঢ় করিয়া বলিব সেই আশ্রমের যে আহবান তাহা সেই শান্তম শিবমদ্বৈতম। যিনি তঁহারই আহবান। আমরা যে যাহা মনে করিয়া আসি না কেন, তিনিই ডাকিতেছেন এবং সে ডাক এক মুহুর্তের জন্য থামিয়া নাই। আমরা কোনো কলরবে সেই অনবচ্ছিন্ন মঙ্গল শঙ্খধ্বনিকে ঢাকিয়া ফেলিতে পারিতেছি না- তাহা সকলের উচ্চে বাজিতেছে, তাহার সুগভীর স্বরতরঙ্গ সেখানকার তরুশ্রেণীর পল্লবে পল্লবে স্পাদিত হইতেছে, এবং সেখানকার নির্মল আকাশের রান্ধে রদ্ধে প্রবেশ করিয়া তাহার আলোককে পুলকিত ও অন্ধকারকে নিস্তব্ধ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতেছে। সাধকদের জন্য অপেক্ষা করিতে হয়; ঠাহারা যখন আসিবেন তখন আসিবেন ; তাহারা সকলেই কিছু গেরুয়া পরিয়া মাথায় তিলক কাটিয়া আসিবেন না- তাহারা এমন দীনবেশে নিঃশব্দে আসিবেন যে তঁহাদের আগমন-বার্তা জানিতেও পারিব না। কিন্তু ইতিমধ্যে ঐ যে সাধনার আহবানটি ইহাই আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো সম্পদ। এই ভূমার আহবানের একেবারেই মাঝখানে আশ্রমবাসীদিগকে বাস করিতে হইতেছে। সেই একাগ্র ধ্বনি তাহদের বিমুখ কর্ণের বধিরতাকে দিনে দিনে ভেদ করিতেছে। সে তাঁহাদের শুষ্ক হৃদয়ের কঠিনতম স্তরের মধ্যেও অগোচরে প্রবেশ করিয়া ধীরে ধীরে রসসঞ্চার করিতেছে। এমন কথা আমি একদিন কোনো বন্ধুর কাছে শুনিয়ছিলাম যে, জনতা হইতে দূরে একটা নিভৃত বেষ্টনের মধ্যে যে জীবনযাত্রা, তাহার মধ্যে একটা শৌখিনতা আছে, তাহার মধ্যে পুরাপুরি সত্য নাই, সুতরাং এখানকার যে শিক্ষা তাহা সম্পূর্ণ কাজের শিক্ষা নহে। কোনো কাল্পনিক আশ্রমসম্বন্ধে এ কথা খাটিতে পারে। কিন্তু আমাদের এই আধুনিক আশ্রমটি সম্বন্ধে এ কথা আমরা স্বীকার করিতে পারি না। সত্য বটে। শহরে জনতার অভাব নাই কিন্তু সেই জনতার সঙ্গে সত্যকার যোগ আছে কয়জন মানুষের ? সে জনতা একহিসাবে ছায়াবাজির ছায়ার মতো। নগরে গৃহস্থ তরঙ্গিত জনতাসমুদ্রের মধ্যে বেষ্টিত হইয়া এক-একটি রবিনসন জুসাের মতাে আপনার ফ্রাইডেটিকে লইয়া নিরালায় দিন কটাইতে থাকেন। এতবড়ো। জনময় নির্জনতা কোথায় পাওয়া যাইবে ? ... ', কিন্তু একশো দুশো মানুষকে এক আশ্রয়ে লইয়া দিনযাপন করাকে কোনােমতেই নির্জন বাস বলা চলে না। এ যে একশো দুশমানুষ ইহার দূরের মানুষ নহে; ইহারা পথের পথিক নহে; ইচ্ছা করিলাম ইহাদের সঙ্গ লইলাম আর ইচ্ছা না হইল তো আপনার ঘরের কোণে আসিয়া দ্বার রুদ্ধ করিলাম। এমনটি হইবার জো । নাই ; এই একশো দুশো মানুষের দিনরাত্রির সমন্ত প্রয়োজনের প্রত্যেক তুচ্ছ অংশটির সম্বন্ধেও চিন্তা করিতে হইবে ; ইহাদের সমস্ত সুখদুঃখ সুবিধা-অসুবিধাকে আপনার করিয়া লইতে হইবে- ইহাকেই কি বলে । মানুষের সঙ্গ এড়াইয়া দায়িত্ব কাটাইয়া শৌখিন শক্তির মধ্যে একটা বেড়া-দেওয়া পারমর্থিকতার দুর্বল ୪୩୩ ? '