পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সঞ্চয় । (¢¢ዓ . যে ব্যক্তি ছােটাে সে বিশ্বসংসারকে অসংখ্যবাধার রাজ্য বলিয়াই জানে, বাধামােত্রই তাহার দৃষ্টিকে বিলুপ্ত করে ও তাহার আশাকে প্রতিহত করে দেয় ; এইজন্য সে সত্যকে জানে না, বাধাকেই সত্য বলিয়া জানে। যে ব্যক্তি বড়ো তিনি সমস্ত বাধাকে ছাড়াইয়া একেবারেই সত্যকে দেখিতে পান। এইজন্য ছোটাের সঙ্গে বড়োর কথার একেবারে এতই বৈপরীত্য। এইজন্য সকলেই যখন একবাক্যে বলিতেছে, আমরা কেবল অন্ধকার দেখিতেছি তখনো তিনি জোরের সঙ্গে বলিতে পারেন- . বেদাহমেতং পুরুষং মহাপ্তং আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পর্যন্তাৎ । সমস্ত অন্ধকারকে ছাড়াইয়া আমি তাহাকেই জানিতেছি যিনি মহান পুরুষ, যিনি জ্যোতির্ময়। এইজন্য যখন স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি, অধৰ্মই আমাকে বীচাইতে পারে এই মনে করিয়া হাজার হাজার লোক জালজালিয়াতি মারামারি কড়াকড়ির দিকে দলে দলে দুটিয়া চলিয়াছে তখনো তাহারা অসংকোচে এমন কথা বলেন যে, স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ- অতি অল্পমাত্র ধর্মও মহাভয় হইতে ত্ৰাণ করিতে পারে ; যখন দেখা যাইতেছে সৎকর্মপদে পদে বাধাগ্ৰস্ত, তাহা মূঢ়তার জড়ত্বপুঞ্জে প্রতিহত, প্রবলের অত্যাচারে প্রাপীড়িত, বাহিরে তাহার দারিদ্র্য সর্বপ্রকারেই প্রত্যক্ষ, তখনো তাহারা অসংশয়ে বলেন, সর্ষপপরিমাণ বিশ্বাস পর্বতপরিমাণ বাধাকে জয় করিতে পারে। র্তাহারা কিছুমাত্র হাতে রাখিয়া কথা বলেন না, মানুষকে খাটাে মনে করিয়া সত্যকে তাহার কাছে খাটাে করিয়া ধরেন না ; তাঁহারা অসত্যের আস্ফালনকে একেবারেই অবজ্ঞা করিয়া বলেন, সত্যমেব জয়তে- এবং সংসারকেই যে-সকল লোক অহােরাত্র সত্য বলিয়া পাক খাইয়া ফিরিতেছে, তাহদের সম্মুখে দাড়াইয়া ঘোষণা করেন- সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম- অনন্তস্বরূপ ব্ৰহ্মই সত্য। যাহাকে চােখে দেখিতেছি, স্পর্শ করিতেছি, যাহাকে জ্ঞানের শেষ বিষয় বলিয়া মনে করিতেছি, সত্যকে তাহার চেয়েও তাঁহারই বড়ো করিয়া দেখাইয়াছেন মানুষের মধ্যে যাহারা বড়ো হইয়া জন্মিয়াছেন । তঁহাদের যাহা অনুশাসন তাহাও শুনিতে অত্যন্ত অসম্ভব। সংসারে যে লোকটি যেমন তাহাকে ঠিক তেমনি করিয়া দেখো এ পরামর্শটি নিতান্ত সহজ নহে। কিন্তু এখানেই তাহারা দাড়ি টানেন নাই ; তাহারা বলিয়াছেন, আপনার মতো করিয়াই সকলকে দেখো । তাহার কারণ এই আত্মাপরের ভেদ যেখানে সেখানেই তঁহাদের দৃষ্টি ঠেকিয়া যায় নাই, আত্মপরের মিল যেখানে সেইখনেই তাহারা বিহার করিতেছেন। শক্রকে ক্ষমা করিবে এ কথা বলিলে যথেষ্ট বলা হইল, কিন্তু তাহারা সে কথাও ছাড়াইয়া বলিয়াছেন, শক্রকেও প্রতিদান করবে। যেমন করিয়া চন্দনতরু আঘাতকারীকেও সুগন্ধ দান করে। তাহার কারণ- এই প্রেমের মধ্যেই তাহারা সত্যকে পূর্ণ করিয়া দেখিয়াছেন, এইজন্য স্বভাবতই সে-পর্যন্ত না গিয়া তাহারা থামিতে পারেন না। তুমি বড়ো হও, ভালো হও, এই কথাই মানুষের পক্ষে কম কথা নয়। কিন্তু তাহারা একেবারে বলিয়া বসেন শরবৎ তন্ময়াে ভবেৎ।। শর যেমন লক্ষ্যের মধ্যে একেবারে নিবিষ্ট হইয়া যায় তেমনি করিয়া তন্ময় হইয়া ব্রহ্মের মধ্যে প্রবেশ করো। ব্ৰহ্মই পরিপূর্ণ সত্য এবং তঁহাকেই পূর্ণভাবে পাইতে হইবে এই কথাটিকে খাটাে করিয়া বলা তাঁহাদের কর্ম নহে- তাই তাহারা স্পষ্ট করিয়াই বলেন যে, তাহাকে না জানিয়া যে মানুষ কেবল জপ তপ করিয়াই কাটায় অস্তবদেবাস্য তদভবতি, তাহার সে সমস্তই বিনষ্ট হইয়া যায়- তাহাকে না জানিয়াই যে ব্যক্তি ইহলোক হইতে অপসৃত হয় স কৃপণঃ- সে কৃপাপাত্র । , অতএব ইহা দেখা যাইতেছে, মানুষের মধ্যে যাহারা সকলের বড়ো তাহারা সেইখানকার কথাই বলিতেছেন যাহা সকলের চরম । কোনো প্রয়োজনের দিকে তাকাইয়া সে সত্যকে তাহারা ছোটাে করেন না। সেই চরম লক্ষ্যকেই অসংশয়ে সুস্পষ্টরূপে সকল সত্যের পরম সত্য বলিয়া স্বীকার না করিলে মানুষকে আত্ম-অরিশ্বাসী ও ভীরু করিয়া রাখা হয় ; বাধার ওপারে যে সত্য আছে তাহার কথাই তাঁহাকে বড়ো করিয়া নী শুনাইয়া বাধাটার উপরেই যদি ঝোক দেওয়া হয় তবে সে অবস্থায় মানুষ সেই বাধার সঙ্গেই আপস। করিয়াই বাসা বাধে এবং সত্যকেই আয়ত্তের অতীত বলিয়া ব্যবহারের বাহিরে নির্বাসিত করিয়া দেয় । । কিন্তু মানবগুরুগণ যে পরম লাভ, যে অসাধ্যসাধনের কথা বলেন তাহাকেইষ্ঠাহীরা মানুষের ধর্ম বলিয়া à lO