পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

er রবীন্দ্র-রচনাবলী থাকেন। অর্থাৎ তাঁহাই মানুষের পরিপূর্ণ স্বভাব, তাহাঁই মানুষের সত্য। যেমনি লোভ হইবে অমনি কড়িয়া খাইবে মানুষের মধ্যে এমন একটা প্রবৃত্তি আছে সে কথা অস্বীকার করিনা কিন্তু তবুইহাকে আমরা মানুষের ধর্ম অর্থাৎ মানুষের সত্যকার স্বভাব বলি না। লোভ হইলেণ্ড লোভ দমন করিবে, পরের অন্নকাড়িয়া খাইবে না, এ কথা বলিলেও কম বলা হয় না- কিন্তু তবু এখানেও মানুষ থামিতে পারে না। সে বলিয়াছে, ক্ষুধিতকে নিজের অন্ন দান করবে, ইহাই মানুষের ধর্ম, ইহাই মানুষের পূণ্য, অর্থাৎ তাহার পূর্ণতা। অথচ লোকসংখ্যা গণনা করিয়া যদি ওজনদরে মানুষের ধর্মবিচার করিতে হয় তবে নিশ্চয়ই বলিতে হইবে নিজের অন্ন পরকে দান করা মানুষের ধর্ম নহে; কেননা অনেক লোকই পরের অন্ন কড়িবার বাধাহীন সুযোগ পাইলে নিজেকে সাৰ্থক মনে করে। তবু আজ পর্যন্ত মানুষ এ কথা বলিতে কুষ্ঠিত হয় নাই যে দয়াই ধর্ম দানই পুণ্য। কিন্তু মানুষের পক্ষে যাহা সত্য মানুষের পক্ষে তাঁহাই যে সহজ তাঁহা নহে। তবেই দেখা যাইতেছে সহজকেই আপনার ধর্ম বলিয়া মানিয়া লইয়া মানুষ আরাম পাইতে চায় না, এবং যে-কোনাে দুর্বলচিত্ত সহজকেই আপনার ধর্মবলিয়াছে এবং ধর্মকে আপনার সুবিধামত সহজ করিয়া লইয়াছে তাহার আর দুৰ্গতির অন্ত থাকে না। আপনি ধর্মের পথকে মানুষ বলিয়ছে- ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয় দুর্গং পথপ্তং কবয়ে বদন্তি। দুঃখকে মানুষ মনুষ্যত্বের বাহন বলিয়া গণ্য করিয়া লইয়াছে এবং সুখকেই সে সুখ বলে নাই, বলিয়ছে- ভূমৈব সুখম। এইজন্যই এই বড়ো একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখা যায় যে, যাহারা মানুষকে অসাধ্যসাধনের উপদেশ দিয়াছেন, যাঁহাদের কথা শুনিলেই হঠাৎ মনে হয় ইহা কোনােমতেই বিশ্বাস করিবার মতো নহে, মানুষ র্তাহাদিগকেই শ্রদ্ধা করে অর্থাৎ বিশ্বাস করে। তাহার কারণ মহত্বই মানুষের আত্মার ধর্ম; সে মুখে যাহাই বলুক শেষকালে দেখা যায় সে বড়োকেই যথার্থ বিশ্বাস করে। সহজের উপরেই তাহার বস্তুত শ্ৰদ্ধা নাই ; অসাধ্যসাধনকেই সে সত্য-সাধনা বলিয়া জানে; সেই পথের পথিককেই সে সর্বোচ্চ সম্মান না দিয়া কোনোমতেই থাকিতে পারে না । যাহারা মানুষকে দুৰ্গম পথে ডাকেন, মানুষ তাহাদিগকে শ্ৰদ্ধা করে, কেননা মানুষকে তাহারা শ্রদ্ধা করেন। তাহারা মানুষকে দীনাত্মা বলিয়া অবজ্ঞা করেন না। বাহিরে তঁহারা মানুষের যত দুর্বলতা যত মূঢ়তাই দেখুন-না কেন তবুও তাহারা নিশ্চয় জানেন যথার্থত মানুষ হীনশক্তি নহে-তাহার শক্তিহীনতা নিতান্তই একটা বাহিরের জিনিস ; সেটাকে মায়াবলিলেই হয়। এইজন্য র্তাহারা যখন শ্রদ্ধা করিয়া মানুষকে বড়ো পথে ডাকেন তখন মানুষ আপনার মায়াকে ত্যাগ করিয়া সত্যকে চিনিতে পারে, মানুষ নিজের মহাত্মা দেখিতে পায় এবং নিজের সেই সত্যস্বরূপে বিশ্বাস করিবামাত্র সে অসাধ্যসাধন করিতে পারে। তখন সে বিস্মিত হইয়া দেখে ভয় তাহাকে ভয় দেখাইতেছে না, দুঃখ তাহাকে দুঃখ দিতেছে না, বাধা তাহাকে পরাভূত করিতেছে না, এমনকি, নিস্ফলতাও তাঁহাকে নিরন্ত করিতে পারিতেছে না। তখন সে হঠাৎ দেখিতে পায় ত্যাগ তাহার পক্ষে সহজ, ক্লেশ তাহার পক্ষে আনন্দময়, এবং মৃত্যু তাহার পক্ষে অমৃতের সোপান। বুদ্ধদেব তাহার শিষ্যদিগকে উপদেশ দিবার কালে এক সময়ে বলিয়ছিলেন যে, মানুষের মনে কামনা অত্যন্ত বেশি প্রবল, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাহার চেয়েও প্রবল পদাৰ্থ আমাদের আছে ; সত্যের পিপাসা। যদি আমাদের রিপুর চেয়ে প্রবলতর না হইত। তবে আমাদের মধ্যে কেইবা ধর্মের পথে চলিতে পারিত। মানুষের প্রতি এত বড়ো শ্ৰদ্ধার কথা এত বড়ো আশার কথা সকলে বলিতে পারে না। কামনার আঘাতে মানুষ বারবার স্বলিত হইয়া পড়িতেছে, কেবল ইহাই বড়ো করিয়া তাহার চােখে পড়ে যে ছােটাে; কিন্তু তৎসত্ত্বেও সত্যের আকর্ষণে মানুষ যে পাশাবতার দিক হইতে মনুষ্যত্বের দিকে অগ্রসর হইতেছে এইটেই বড়ে করিয়া দেখিতে পান। তিনিই যিনি বড়ো। এইজন্য তিনিই মানুষকে বারংবার নির্ভয়ে ক্ষমা করিতে পারেন, তিনিই মানুষের জন্য আশা করিতে পারেন, তিনিই মানুষকে সকলের চেয়ে বড়ো কথাটি শুনাইতে আসেন, তিনিই মানুষকে সকলের চেয়ে বড়ো অধিকার দিতে কুষ্ঠিত হন না। তিনি কৃপণের ন্যায় মানুষকে ওজন করিয়া অনুগ্রহ দান করেন না, এবং বলেন না। তাঁহাই তাহার বুদ্ধি ও শক্তির পক্ষে যথেষ্ট-প্রিয়তম বন্ধুর ন্যায় তিনি আপন চিরজীবনের সর্বোচ্চ সাধনের ধন তাহার নিকট সম্পূর্ণ শ্ৰদ্ধার সহিত উৎসর্গ করেন।